গাঁড়াদহ গ্রামের সেই জৌলুশ আজ আর নেই, বসে না শীতের সেই যাত্রার আসরও
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আমার শৈশব কেটেছে। গ্রামের নাম গাঁড়াদহ। এ গ্রামের আশির দশকের চিত্র আজও মন থেকে মুছতে পারি না। গ্রামের চারপাশে ছিল আমবাগান-বাঁশবাগান, কোথাও লতাগুল্মের ঘন জঙ্গল। কাঁচা রাস্তা ধরে গাঁড়াদহ বাজারে যাওয়ার সময় পথের দুই পাশে পড়ত বিশাল আকৃতির দুটি তেঁতুলগাছ। গাছের ডালে বাঁধা থাকত শত শত লাল রঙের গামছা, গোড়ায় জ্বলন্ত মোমবাতি। গাছ দুটি পার হলেই বাগদিদের বসতি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের এই মানুষেরা বিয়েবাড়িতে ঢাকঢোল, করতাল বাজাত। বর-কনেকে পালকি করে ‘হেঁইয়ো’, ‘হেঁইয়ো’ সুর করে নিয়ে যেত দূর দূর গ্রামে।
গ্রামের উত্তর দিকেও একটি হাট বসত—বুধবারের হাট। এই হাট ছোট হলেও সাজানো গোছানো। করতোয়ার কোল ঘেঁষে ছিল বাসস্ট্যান্ড। যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আশপাশের সব গ্রামের মানুষের যাতায়াত ছিল। গ্রামের ঠিক মাঝখানেই একটি খেলার মাঠ, পাশেই একটা বটগাছ। শতবর্ষী গাছটি মাঠের বহু ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। গ্রামে ঢুকতেই কবরস্থান, উল্টো পাশে শ্মশানঘাট, পাশ দিয়ে গেলেই ছমছম করত গা। আর ছিল নারিনা বিল।
শীতে গ্রামে যাত্রার আসর বসত। মুকুট পরে রাজার পাঠ করতেন মাস্টার কাকা। মুকুট পরে তিনি যখন সিংহাসনে বসতেন কেউ চিনতেই পারত না, এ আমাদের মাস্টার কাকা। মনে হতো এ যেন রূপকথার কোনো রাজা। একটি ডায়ালগ আমার খুব মনে পড়ে, ‘যদি তোমাকে না পাই তাহলে এই রাজ্য দিয়ে কী হবে, প্রয়োজনে রাস্তার ভিখিরি হব, তবুও তোমাকে চাই।’ বাজখাঁই গলায় বাক্যগুলো যখন পাঠ করতেন, চারদিক থেকে হাততালি পড়ত, অনেকে কাঁচা পয়সাও ছিটিয়ে দিত।
গাঁড়াদহ বাজারের উত্তর পাশে টংঘরের মতো ছোট কয়েকটি টিনের দোকান, দুজন দরজির দোকান। একেবারে পুব পাশে ডাক্তারের ডিসপেনসারি। একটি দোকান অবশ্য অনেক বড় ছিল। দোকানটির কথা খুব মনে পড়ে, পুরোনো মরচে পড়া টিনের দোকান, বিভিন্ন তাকে সাজানো থাকত শত শত ছোট টিনের কৌটা, পাওয়া যেত ফিটকিরি, সোনামুখী সুই, বইয়ের মলাট লাগানোর আঠা, আমলকী, হরীতকী আরও কত কী! খাঁটি দুধ, খাঁটি গুড়ের জন্য বিখ্যাত এই বাজার, সকাল হলেই বাঁশের ঝাঁকায় করে সবজি, নদী-ডোবা-বিলের মাছে ভরে উঠত বাজার।
আর একজন গ্রাম্য ডাক্তারের ডিসপেনসারির সামনে সকাল হলেই ভিড় করত রোগীরা। অনেকক্ষণ ধরে রোগীর রোগলক্ষণ শুনতেন ডাক্তার ইউনুছ আলী, তারপর মনে মনে কী যেন ভাবতেন, শেষে ওষুধ দিতেন। বেশির ভাগ রোগীই ভালো হতো, গ্রাম্য একজন ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে এত রোগী কেমন করে ভালো হতো কে জানে! সকালের রোগী দেখা শেষ হলে পায়ে পাম্প শু, মোটা কাচের চশমা, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সাইকেলে করে গ্রাম থেকে গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীর খোঁজ নিতেন তিনি। সকালের বাজার শেষ হয়েও শেষ হতো না। ঝিঁঝিডাকা সন্ধ্যায় দূরদূরান্তের লোকজন আবার বাজারে এসে জ্যোৎস্নারাতে সুখ-দুঃখের গল্প করত, তারপর রাত ঘনিয়ে এলে যার যার বাড়ি ফিরে যেত।
এমনই সুখ-দুঃখের সাথি ছিল গাঁড়াদহ বাজার।
গ্রামের মতো গাঁড়াদহ বাজারেরও আজ আর সেই জৌলুশ নেই, বাসস্ট্যান্ড অন্য গ্রামে স্থানান্তর হয়েছে, সেই যাত্রাপালাও নেই।
আবার কি ফিরে পাব সেই সোনালি দিনগুলো?
আপনিও লিখুন
প্রিয় পাঠক, আপনিও লিখুন ‘ছুটির দিনে’র নিয়মিত বিভাগ ‘জীবন যেমন’–এ। লিখে জানাতে পারেন জীবনের কোনো সুখ–স্মৃতি, রোমাঞ্চ–জাগানিয়া ঘটনা, উত্থান–পতন, পাওয়া না–পাওয়ার গল্প।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা
প্র ছুটির দিনে, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন
২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা–১২১৫
ই-মেইল: [email protected]
ফেসবুক পেজ: fb.com/ChutirDine
খামের ওপর বা ই–মেইলের subject-এ লিখুন ‘জীবন যেমন’।