নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়: অনেক তারকার ক্যাম্পাস
শুরুতে পরিকল্পনা ছিল, ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় হবে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। পরে অবশ্য আর দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই এটি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে, কিন্তু জাতীয় কবির নাম যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে আছে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দেবে না, তা কী করে হয়! শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে তা হতে দেনওনি। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্যাম্পাস থেকে উঠে এসেছেন বেশ কয়েকজন তারকা।
উপাচার্য নিজেই যখন তারকা
#নজরুলবিশ্ববিদ্যালয় লিখে ফেসবুকে সার্চ করতেই পাওয়া গেল বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের বেশ কিছু পোস্ট। এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে নিজের ভাবনাও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া সেসব পোস্টে শিক্ষার্থীদের মন্তব্যও পাওয়া যায়।
উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই সৌমিত্র শেখর পরিচিত মুখ। সভা-সেমিনার থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শো কিংবা রিয়েলিটি শো—নানা ক্ষেত্রে তাঁকে পাওয়া গেছে। গত ২৮ জুলাই ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে তিনি বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা। উপাচার্য বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির নামই জাতীয় কবির নামে। এটি আমাদের পরিচিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে কাজ করেন এমন ব্যক্তিত্বের সমাহার যদি আমরা করতে পারি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়টি আরও পরিচিতি পাবে।’
আছেন গানের মানুষ, নাটকের মানুষ
অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক। তাঁর নেতৃত্বে টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখদের নিয়ে বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও তৈরি করেছেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘মনপাচিত্র’ নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মনোজ। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরাই বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য নাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করছেন। সম্প্রতি মনপাচিত্রের প্রযোজনায় ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আহসাবুল ইয়ামিন তৈরি করেছেন যায় যায় দিন। স্টুডেন্ট ওয়ার্ল্ড ইমপ্যাক্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি ‘অনারেবল মেনশন’ স্বীকৃতি পেয়েছে। মনপাচিত্রের সদস্য মানব মিত্র, মুনসিফ মিমের তৈরি টিভি নাটকগুলোও প্রশংসা পেয়েছে। এসব কাজের সেট ডিজাইন, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, কস্টিউম ডিজাইন, প্রযোজনা—সবই করেন শিক্ষার্থীরা।
কোক স্টুডিও বাংলায় ‘নাসেক নাসেক’ গেয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন অনিমেষ রায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী। একই বিভাগের কানিজ খন্দকারও কোক স্টুডিও বাংলাতে গেয়েছেন লালনের গান ‘সব লোকে কয়’। শুধু অনিমেষ বা কানিজ নন, সোহাগ বণিক, নুর রহমানসহ সংগীত বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের প্রথম সারির টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত গান গাচ্ছেন।
এভাবেই জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে কাজ করতে গেলে অনেক সময়ই ক্যাম্পাসের বড়-ছোটদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বিষয় খুবই ভালো লাগার অনুভূতি দেয় বলে জানান অনিমেষ রায়। বলছিলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে বা ক্যাম্পাসের বাইরে ভালো কোনো কাজে ক্যাম্পাসের কাউকে পেলে খুবই ভালো লাগে। যাঁরা আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন, তাঁদের দেখে আরও অনুপ্রাণিত হই।’
পরিবেশই ‘টনিক’
কথা হলো ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক, অভিনেতা মনোজ প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টি বাইরের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত। আবার ঢাকা থেকে দূরত্বও খুব বেশি নয়। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগও ভালো। আবার গ্রামীণ পরিবেশের কারণে মনোযোগ ধরে রাখাটাও সহজ হয়।’
একই সুরে কথা বললেন কানিজ খন্দকারও। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর চর্চার জন্য খুব ভালো পরিবেশ আছে বলে আমার মনে হয়। এই পরিবেশই কলা অনুষদ তো বটেই, বাকি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যও টনিক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে শিক্ষকদের কথা আলাদা করে বলতে হয়। তাঁরা আমাদের যে পরিমাণ সহযোগিতা ও অনুপ্রাণিত করেন, সেটিও এগিয়ে রাখে।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগের বিষয়টা পরিষ্কার করলেন মনোজ। তাঁর বক্তব্য, ‘সাধারণত দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এক ধরনের সামাজিক দূরত্ব থাকে। সেই দূরত্বটা এখানে কম দেখতে পাই। আমাদের ক্যাম্পাসটা ছোট। তাই সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগটা সহজে হয়। এসব বিষয়ের কিছুটা প্রভাব অবশ্যই আছে।’
‘নজরুল বিশ্ব’ গড়ে তোলার স্বপ্ন
ক্যাম্পাসের নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ঘুরে দেখে আমরা বসেছিলাম শিক্ষার্থীদের পছন্দের আড্ডার জায়গা—চন্দ্রবিন্দু ক্যাফেতে। সঙ্গে ছিলেন উপাচার্য সৌমিত্র শেখর। তিনি বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিকট ভবিষ্যতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত ব্যক্তিত্ব আরও বাড়বে। আমি আশাবাদী এই কারণে যে এখানে আমরা চর্চার সুযোগটা অবারিত করার চেষ্টা করছি। শুধু কলা অনুষদ নয়, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ নিয়েও আমাদের একই পরিকল্পনা আছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত বিজ্ঞানীও পাচ্ছি।’
পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি নন্দনকানন হিসেবে গড়ে তুলতে চান উপাচার্য সৌমিত্র শেখর। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসকে একটা নতুন বিশ্ব রূপে গড়ে তুলতে চাই। যেটি হবে নজরুল বিশ্ব। এখানে পা রাখলেই মানুষ আরেকটা জগতে ঢুকবে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক হবে—তাঁরা নজরুল বিশ্বের সদস্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য। এখানে ২৪ ঘণ্টা কাজের মতো পরিবেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। সেই পরিবেশ যদি গড়ে তুলতে পারি, তাহলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আরও বাড়বে বলে বিশ্বাস করি।’