নব্বই দশকের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তখন ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ। তিনি ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের আগ্রাসী নদীগুলোর দুই পাশে যদি হল্যান্ডের মডেল অনুসরণ করে বাঁধ দেওয়া যায়, তবে বন্যাপীড়িত জনগণের কষ্ট কমবে। তৈরি হলো ‘ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান’, যার সমর্থনে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ পেয়েছিল যো প্রোডাকশন। প্যারিসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পুরুষ লেওঁ দেক্লোযো। ছবি তৈরির সময় যমুনার চরের ভূমিপুত্রদের সঙ্গে আলাপ করে লেওঁ এবং তাঁর চিত্রায়ণ দল বুঝতে পারে, বাংলাদেশে নদীতীরে বাঁধ নির্মাণ খুবই বিধ্বংসী এবং ক্ষতিকর একটা সিদ্ধান্ত হবে। প্রামাণ্যচিত্রে ব্যাপারটা পরিষ্কার ও সাহসী ভাষায় বলা হয়। কর্তৃপক্ষ যা খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি।

দুই বছর পর, ১৯৯২ সালে যমুনার চরের জীবনের ওপর তাদের দ্বিতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে যো প্রোডাকশন। একদিন শুটিং শেষে ফেরার সময় গাবতলী সেতুর অদূরে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্যে লেওঁর দৃষ্টি আটকে যায়, ঠক-ঠক-ঠক। ঘোমটা মাথায় সুন্দরী, অল্পবয়সী এক গাঁয়ের বধূ হাতুড়ির আঘাতে কঠিন পাথর ভেঙে চলেছেন। কয়েক দিন পর ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়পীড়িত বাঁশখালীতে শুটিং করে ফেরার সময় লেওঁ দেখেন কুমিরা-ভাটিয়ারী এলাকায় বেলাভূমিতে লোহালক্কড়ে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় সারে সারে দাঁড়িয়ে আছে বাতিল সব জাহাজ।

পাথরভাঙা সৌন্দর্য ও মুমূর্ষু জাহাজ এ দুটি ছবি যো প্রোডাকশনের অফিসের দেয়ালে ঝুলে থাকে দীর্ঘ ছয় বছর। এ ছবি দুটি লেওঁকে বাংলাদেশের ওপর একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। অবশেষে ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে ১৯৯৮ সালের বর্ষারম্ভে বড়সড় একটি ফিল্ম দল নিয়ে ঢাকায় হাজির হন লেওঁ। তৈরি হয় গন্তব্য চট্টগ্রাম। ছবিটি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ডে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। কানাডার কুইবেক, রাশিয়াসহ একাধিক দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, ‍বাংলাদেশের গল্প নিয়ে তৈরি ফরাসি চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে কখনো মুক্তি পায়নি।

লেওঁয়ের নিজের জীবনও কম নাটকীয় নয়। পরিবারের চাওয়া মতো ইংরেজির শিক্ষক না হয়ে চিত্রপরিচালক হতে চাওয়ার অপরাধে তরুণ বয়সেই তাঁকে পৈতৃক বাড়ি ত্যাগ করতে হয়েছিল। এরপর ইঞ্জিনচালকের কাজ করতে করতে প্যারিসের থিয়েটার আর সিনেমার বিখ্যাত বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ নেন লেওঁ। পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে শতাধিক প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য ছাড়াও লেওঁর ঝুলিতে রয়েছে তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি—মোরা (১৯৮২), গন্তব্য চট্টগ্রাম (২০০০) এবং কার্গো-হারিয়ে যাওয়া মানুষ (২০১০)।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত লিবারেশন ডক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বিচারক হয়ে সম্প্রতি আবার ঢাকা এসেছিলেন লেওঁ দেক্লোযো। তখন তাঁর সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলাম।

গন্তব্য চট্টগ্রাম ছবির গল্পটা বলবেন?

পল নামের এক ফরাসি নাবিক তার মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ নিয়ে আসে চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে। ট্রেন ও লঞ্চে ভ্রমণ করার সময় গ্রাম্যবধূ আলিমা ও বালকপুত্র মতির সঙ্গে পলের দেখা হয়। আলিমাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে যায় পল। অচিরেই সমস্যার সূত্রপাত। গ্রাম্য সালিসে পল ও আলিমাকে সমাজচ্যুত করা হয়। ইতিমধ্যে শুরু হয় বন্যা। আলিমাকে বেনোজলে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে পল। মতি হারিয়ে যায়, কিন্তু অবশেষে আলিমা আর পল তাকে খুঁজে পায় এবং তিনজন একটি লঞ্চে করে ঢাকার দিকে রওনা দিলে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়।

ছবির লোকেশন হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেওয়ার কারণ কী ছিল?

বাংলাদেশের দারুণ একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। পৃথিবীর খুব কম লোকই এ সৌন্দর্যের কথা জানে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময় এ সৌন্দর্যে আমি নিজে আভিভূত হয়েছিলাম, এই অপরূপ সৌন্দর্য সেলুলয়েডে ধারণ করে বাকি পৃথিবীকে দেখাতে চেয়েছিলাম।

বাংলাদেশে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মধুর স্মৃতিই বেশি। দু-একটি অতি তিক্ত স্মৃতিও অবশ্য আছে। তিক্ত স্মৃতির কথাই বলি। আলিমার ভূমিকায় যে বাংলাদেশি নায়িকাকে আমরা নিয়েছিলাম, তিনি আমাদের ওপর রেগে গিয়েছিলেন দুই কারণে। প্রথমত, আমরা কোনো মেকআপ ব্যবহার করতাম না। দ্বিতীয়ত, আমরা রাস্তাঘাটের লোকজনকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছি, পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী তেমন একটা নিইনি। কী ভেবে সেই নায়িকা কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করলেন যে আমরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছি। অনতিবিলম্বে আমাদের শুটিং বন্ধ করতে বলা হলো। কয়েক মাস শুটিং বন্ধ থাকল। যে শুটিং এক মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল, ছয় মাসেও সেটা শেষ হয়নি। ছয়-ছয়টি মাস ধরে ক্রুদের বেতন আর যন্ত্রপাতির ভাড়া গুনতে গিয়ে আমার প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। যমুনার যে চরে আমরা শুটিং করছিলাম, সেটি বন্যায় প্রায় তলিয়ে যাচ্ছিল। তবে স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশি কলাকুশলীরা খুবই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের কারণে আমরা অবশেষে শুটিং শেষ করতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশের লোকজন সব সময় একটা কথা বলে, ‘নো প্রবলেম’। আসলেই এ দেশে যেকোনো সমস্যার একটা সমাধান হয়ই, আগে আর পরে।

২৫ বছর পর বাংলাদেশে এসে কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি চোখে লাগছে?

অবশ্যই মহান যানজট। বিমানবন্দর থেকে গুলশানে আসতে আমার চার ঘণ্টা লেগেছে!

প্রায় তিন দশক ধরে এ দেশের মানুষকে দেখছেন, এ দেশ ও জাতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

যেমন সুন্দর এই দেশ, তেমন সুন্দর এই দেশের মানুষ, অন্তত আমার চোখে। বাঙালিরা হাসতে জানে এবং হাসিটা মোটেই কৃত্রিম নয়। আশপাশের লোকজনকে তারা ভালোবাসে। তাদের পারিবারিক বন্ধন বেশ দৃঢ় এবং পরিবার থেকেই এই ভালো গুণগুলো তারা পেয়েছে। গতকাল আমি গুলশানের বাজার এলাকায় একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম। আমার চারপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল, আড়াই দশক আগেও যেমন জমত। একজন ভাঙা ইংরেজিতে আমার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। যখন বললাম, আমি চিত্র পরিচালক, সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইল।

আপনার পর দ্বিতীয় কোনো পশ্চিমা পরিচালক আর বাংলাদেশে ছবি করতে এলেন না, এর কারণ কী?

ব্যাপারটা দুঃখজনক। আগেই বলেছি, ছবির পশ্চাৎপট হিসেবে বাংলাদেশের কোনো তুলনা নেই। ১৯৯৮-এর বন্যায় আমরা ভূঞাপুরের কাছে যমুনার চর রুলিপাড়া, চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, ঢাকার সদরঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় শুট করেছি। আমার ছবিতে তখনকার বাংলাদেশের দারুণ সব চিত্র আপনারা দেখতে পাবেন। পৃথিবীর উন্নততম স্টুডিওতে কোটি ডলার খরচ করেও এমন পশ্চাৎপট নির্মাণ সম্ভব নয়। পাশ্চাত্যের পরিচালকেরা এখনো স্টুডিওর সেটের তুলনায় প্রাকৃতিক দৃশ্যের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে উঠতে পারেননি। এ ধরনের দৃশ্য শুধু বাংলাদেশের মতো দেশেই সহজলভ্য। পাশ্চাত্যের পরিচালকেরা যদি এসব দৃশ্যের মূল্য বুঝতেন, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা এবং কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারত সিনেমা।

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রনির্মাতাদের প্রতি আপনার কিছু বলার আছে?

শুনেছি বাংলাদেশে বেশ কিছু ভালো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে ইদানীং। নবীনদের কাজ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের প্রতি আমার আবেদন, সাহস ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সমৃদ্ধ এ সমাজ আর সুন্দর এই দেশকে ‘ঘর’এবং ‘বাইরে’র মানুষের কাছে তুলে ধরুন।

শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও গন্তব্য চট্টগ্রাম ছবির নির্বাহী প্রযোজক