১০ ছেলেমেয়েকেই যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন ফয়জুন্নেসা

হাফিজা খাতুনরা ছিলেন দশ ভাই–বোন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজে জড়িয়েছিলেন প্রত্যেকেই। আর এই কাজে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছেন তাদের মা। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুনের কাছে সেই মা আর তাঁর সন্তানদের গল্প শুনলেন সরোয়ার মোর্শেদ।

‘১৯৭১ সালে মায়েরা সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাঁরাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ও শক্তি। যেমন আমার মা তাঁর প্রত্যেক সন্তানকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে বলেছিলেন। দুই ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছোট ছেলেকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সংগ্রহ করে দিতেন। এসব মহান মায়ের জন্যই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।’

আরও পড়ুন

বলছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) উপাচার্য হাফিজা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সরকারি মহিলা কলেজে (বর্তমান বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ) উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন তিনি। তাঁর ভাই আবু রাইহান মাহমুদ সেক্টর ৩–এর অধীনে সিলেট এবং আবুল হাসান মাসুদ সেক্টর ২–এর অধীনে ঢাকা কোতোয়ালি থানার বংশাল অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। তাঁদের বংশালের পৈতৃক বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ইউনিটের ঘাঁটি। হাফিজা খাতুন এবং তাঁর ভাই–বোনেরা সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেসব গল্প শুনতেই ১১ ডিসেম্বর হাজির হয়েছিলাম পাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুন
ছবি: হাসান মাহমুদ

গেরিলা ঘাঁটির দিনগুলো

সময় পেলেই অধ্যাপক হাফিজা খাতুন তাঁর শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আসর করেছেন।

হাফিজা খাতুন জানান, তাঁর দশ ভাই–বোনের প্রত্যেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় কাজ করেছেন। আর এর মূলে ছিলেন মা বেগম ফয়জুন্নেসা। বাবা মাওলানা কবির উদ্দিন রহমানী আগেই মারা গিয়েছিলেন। ফলে মা ছিলেন তাঁদের একমাত্র ভরসার স্থল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে আগুন দেয়, হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। এ সময় হাফিজা, তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোন হামিদা শিরিন ও ছোট ভাই আবু মঞ্জুর মোর্শেদকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা। বাধ্য হন ঢাকা ছাড়তে। গাজীপুরের বড় কয়ের গ্রামে, দাদার বাড়িতে আশ্রয় নেন তাঁরা। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে সন্তানদের নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন মা।

বেগম ফয়জুন্নেসা
ছবি: সংগৃহীত

তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে গড়ে ওঠে গেরিলা ঘাঁটি। হাফিজার ভাই আবু রাইহান মাহমুদের নেতৃত্বে গেরিলারা তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। প্রতিটি অপারেশন শেষ করে এই বাড়িতেই ফিরে আসতেন। অনেকে আহত হয়ে, গুলিবিদ্ধ হয়ে ফিরতেন। রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন মা। হাফিজা, হামিদা ও মঞ্জুর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতেন। অস্ত্র পরিষ্কার করে দেওয়া, ওষুধ দেওয়া, জামাকাপড় পরিষ্কার করাসহ অন্যান্য কাজ করতেন তাঁরা। অনেক সময় বোমা তৈরিতেও সহযোগিতা করেছেন।

হাফিজা খাতুন জানান, তাঁদের মধ্যে সবার ছোট ছিল ভাই। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সংগ্রহের কাজে তাঁকেই বেশি ব্যবহার করা হতো। ছোট বোনও এই কাজ করেছেন। লুকিয়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দিতেন তাঁরা। সব সময় সাহস দিয়েছেন মা।

দশে মিলে করি দেশের কাজ

হাফিজা খাতুনের বড় বোন হাসিনা খাতুন দিনাজপুরে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন। পরের বোন হাবিবা খাতুন কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। ভাই আবুল ফজল মোহাম্মদ কানাডায় পড়তেন। তিনি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংগঠনের সভাপতি ছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি পাকিস্তানবিরোধী জনমত গঠনের কাজ করতেন। টাকা তুলে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠাতেন। পাকিস্তান সরকার তাঁর বৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিল।

আরেক বোন চিকিৎসক লতিফা শামসুদ্দিন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্থ করে তুলতেন। তিনি স্থানীয় মহিলা সমিতির সদস্যও ছিলেন। বগুড়ার কলাতলা এলাকায় যুদ্ধশিশু ও নারীদের জন্য একটি ক্যাম্প করেছিলেন। তাঁদের পুনর্বাসনের কাজও করেছেন। তাঁদের মেজ দুলাভাই আবদুল খালেক কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সহযোগিতার জন্য সরকারি পরিচয়পত্র (ডান্ডি কার্ড) করে দিয়েছিলেন।

হাফিজা খাতুন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ভয়াবহ। আমরা কেউ কোথাও নিরাপদ ছিলাম না। বাড়িটি ছিল পাকিস্তানিদের তালিকাভুক্ত। তবে প্রতিবেশীরা খুব সহযোগিতা করতেন। তাঁরা সব জেনেও চুপ থাকতেন। সজাগ থেকে খবর পৌঁছে দিতেন।’

দুই যোদ্ধা যা বললেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই দেখা হয় হাফিজা খাতুনের ভাই, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসান মাসুদ এবং ছোট ভাই আবু মনজুর মোর্শেদের সঙ্গে। তাঁরা বোনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে এসেছেন। ৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পও শুনিয়েছেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পও শুনিয়েছেন তাঁরা
ছবি: সংগৃহীত

আবুল হাসান বলেন, ‘৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর আমরা ঢাকা শহরের তরুণেরা একটা কিছু করার জন্য ছটফট করছিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে তো অস্ত্র নেই। তারপর বন্ধুরা মিলে আগরতলা যাই এপ্রিলের শুরুতে। সেখানে মেলাঘর ক্যাম্পে যোগ দিয়ে তিন সপ্তাহের যুদ্ধকৌশল শিখে দেশে আসি। মুক্তিযুদ্ধের সুপারহিরো এ টি এম হায়দারের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিই। সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বোমা বিস্ফারণ ঘটাই। ২৪ সেপ্টেম্বর হাবিব ব্যাংকের হাটখোলা শাখায় অপারেশন চালানো হয়। সেখান থেকে সংগৃহীত অর্থ মুক্তিযুদ্ধসহায়ক ফান্ডে পাঠানো হয়। সেই খবর বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। প্রকাশ্যে মতিঝিল এলাকায় বোমা ফাটানো হয়। মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি ছিনতাই করা হয়। দিনগুলো ছিল লোমহর্ষক। তবে সবকিছুর অনুপ্রেরণা ছিলেন আমাদের মা আর সহযোগী ছিল বোনেরা।’

আবুল হাসান যোগ করেন, ‘আমাদের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। গ্রামের মানুষ বিনা খরচে আমাদের থাকতে দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধ করা সম্ভব হতো না।’

আবুল হাসানের ছোট ভাই আবু মনজুর মোর্শেদ বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। বংশাল আর শাঁখারীবাজার এলাকায় কেবল রক্ত আর রক্ত, ক্ষতবিক্ষত মৃত মানুষ আর জ্বলন্ত মানুষকে আমি দেখেছি মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেই বয়সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন আমার পরিবারের সবাই। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করেছি।’

হাফিজা খাতুনরা কেউ কখনো স্বীকৃতি চাননি। একটা বাংলাদেশ পেয়েছেন, এটাই তাঁদের তৃপ্তি। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর যখন দেখেন, স্বাধীন চিন্তা উপেক্ষিত হচ্ছে, কষ্ট পান তাঁরা। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠার আহ্বান জানান।