হাতিটা আমাকে তাড়া করল

বন্য হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। শেরপুরের গারো পাহাড়ে গিয়ে দুই বছর ধরে এই দ্বন্দ্বের ছবিই তুলছেন আলোকচিত্রী কে এম আসাদ। ‘ফাইট ফর হোম’ বা আবাসস্থলের জন্য লড়াই শিরোনামে আসাদের এই কাজ এবার ইতালির সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ডের ‘স্টোরিবোর্ড’ শাখায় যৌথভাবে তৃতীয় হয়েছে। এটি ছাড়াও প্রতিযোগিতার ‘ফ্যাসিনেটিং ফেসেস অ্যান্ড ক্যারেক্টারস’ শাখায় আসাদের তোলা আরেকটি ছবি দ্বিতীয় হয়েছে। আলোকচিত্রীর কাছে হাতি–মানুষের সংঘাতময় মুহূর্তের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা শুনলেন সজীব মিয়া

আলোকচিত্রী কে এম আসাদের তোলা ‘ফাইট ফর হোম’ সিরিজের একটি ছবি, ৮ এপ্রিল ২০২২

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মানুষের হাতে বেশ কয়েকটি হাতির মৃত্যু হলো। খবরটি প্রথম আলোতে পড়ে ভেতরটা নাড়া দিল। আলোকচিত্রী হিসেবে নানা বিষয় নিয়ে কাজ করি। ছবিতে আমি গল্প খোঁজার চেষ্টা করি। গল্পের মধ্যেও অনেক সমস্যার সমাধান সন্ধান করি। তাই খবরটা পড়ে বসতি ও খাদ্যের জন্য হাতি ও মানুষের এই লড়াই নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হলো।

হাতির মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছিল কক্সবাজার ও শেরপুরে। মৃত্যুর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়ি বন উজাড় হয়ে গেছে। আবাস ও খাদ্যসংকটে পড়েছে হাতিসহ বন্য প্রাণী। ওদিকে সিলেট থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত ভারত সীমান্ত ধরে যে পাহাড়ি এলাকা, সেখানেও হাতির খাবারের অভাব। বছরের একটা সময় তাই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হাতির দল। শেরপুর-জামালপুর জেলার গারো পাহাড়ের লোকালয়ের কাছে কয়েক মাস এদের দেখা যায়। ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে হাতির দল তাড়িয়ে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। হাতি আর মানুষের এই যে দ্বন্দ্ব, এর সমাধান কী?

আরও পড়ুন
বন্য হাতির পাল
ছবি: কে এম আসাদ

২০২১ সালের নভেম্বরে শেরপুরে ছবি তুলতে যাই। গারো পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়াই। বন্য প্রাণীর ছবি তোলার জন্য ভাগ্যেরও যোগ লাগে। অনেক সময় অনেক দিন চেষ্টা করেও সঠিক ছবিটা তোলা যায় না। কিন্তু আমার কপাল ভালো, নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁওয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় হাতির দলের দেখা পেয়ে যাই। স্থলবন্দর আর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্য জায়গাটা পরিচিত। মানুষের সঙ্গে হাতির মুখোমুখি হওয়ার কিছু মুহূর্ত ক্যামেরায় ধারণ করি।

দুই বছর ধরে এভাবে বেশ কয়েকবার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ছবি তুলেছি। কাজটি এখনো চলমান। ছবি তুলতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একবার হাতির ধাওয়াও খেয়েছি।

হাতি তাড়াতে যাচ্ছেন গ্রামবাসী
ছবি: কে এম আসাদ

পানিহাটার ধাওয়া

‘হাতি নামছে রে, হাতি’—পাঁচ–ছয় শ মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে এই একটি বাক্যই শোনা যাচ্ছে বেশি। বিকেলে একদফা হাতির দলকে তাড়ানো হয়েছে। হাতি ফসলি জমি থেকে সরে গেলে আবার লোকালয়ে ফিরে আসেন এলাকাবাসী। এখন এই রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে ধানি জমির কাছে হাতি নামার খবর।

কষ্টের ফসল আর ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য এলাকার সবাই এককাট্টা। সবার হাতে আগুনের গোলা, লাঠি, শব্দযন্ত্রসহ নানা কিছু। কাছেই হাতি হুংকার দিয়ে ওঠে। আমি কিছুটা পথ যাওয়ার পর একজন বলে ওঠেন, ‘ভাই, আপনি নতুন মানুষ, আর সামনে যাইয়েন না।’ আমি থেমে যাই।

নালিতাবাড়ীর এই এলাকাটার নাম পানিহাটা। ভারত সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের গ্রাম। সেই রাতে হাতির দলটাকে সরিয়ে দিয়ে অনেকে বাড়ি ফেরেন, কেউ কেউ আবার ফসলি জমির পাশে মাচায় বসে পড়েন। তাঁদের সঙ্গে আমিও একটি মাচায় বসে থাকি। ধান একটু বড় হলে পাহারা দিতে এমন মাচা বানান স্থানীয় বাসিন্দারা। ফসল রক্ষার জন্য তাঁদের কত চেষ্টা। মাচায় শুয়েই রাত কাবার করে দিই। শেষ রাতে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। ভোরে একজনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর ডাকার কারণ, হাতির পাল খুব বেশি দূরে যায়নি। লোকালয়ের পাশে পাহাড়ের একটা জায়গায় আছে। ক্যামেরা, ট্রাইপড নিয়ে তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখি, পালে ৬০-৭০টা হাতি।

প্রতিযোগিতার ‘ফ্যাসিনেটিং ফেসেস অ্যান্ড ক্যারেক্টারস’ শাখায় আসাদের তোলা এই ছবিটি দ্বিতীয় হয়েছে

দিনভর সেখানেই থাকে হাতির দল। ফসলে যেন মুখ দিতে না পারে, এ জন্য গ্রামবাসীও প্রস্তুত। পরদিনও শুনি, সেখানেই আছে হাতির পাল। একজনের সঙ্গে ওদিকটায় যাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি, একজন জঙ্গল থেকে ছুটে আসছেন। তাঁকে হাতি তাড়া করেছে বুঝতে পেরে আমরাও দৌড় দিই। কিছুটা দূর থেকে পেছনে ফিরে দেখি, তেড়েফুঁড়ে বন থেকে বেরিয়ে আসছে হাতি। এবার ভোঁ–দৌড়। অনেকটা পথ এসে বুঝতে পারি, আমার পেছনের লোকটা খেতের আলে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন, থেমে যাই। হাতির দিকে ট্রাইপড তাক করি। হাতিটাও থমকে দাঁড়ায়। তার শরীর থেকে ধুলা উড়ছে। গা ঝাড়া দিলে বাতাসে উড়তে থাকে ধুলা। তারপর সবুজ ধানগাছ শুঁড়ে পেঁচিয়ে×উপড়ে ফেলে।

আমি জানি, হাতিকে বিরক্ত না করলে সে কখনো আক্রমণ করবে না, বেপরোয়া আচরণ করবে না। চুপচাপ কয়েকটা ছবি তুলে পেছাতে থাকি। হাতিটাও একসময় বনের ভেতরে চলে যায়। জানে বেঁচে ফেরার সেদিনের অনুভূতিটা কখনো ভুলব না। এটা গত বছর এপ্রিলের ঘটনা।

এভাবে বিভিন্ন সময় তোলা ছবি থেকেই ৯টি বাছাই করে সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ডে পাঠিয়েছিলাম। এমন বৈশ্বিক একটা পুরস্কার পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের। কাজটা ভালোভাবে শেষ করতে দারুণ অনুপ্রেরণা জোগাল।