এই অভিনেত্রী একজন প্রকৌশলী, বানিয়েছেন অ্যাপও

অনেকেই হয়তো জানেন না, আদতে তাপসী পান্নু একজন প্রকৌশলী। ভারতের বিরলা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (বিটস) এক অনুষ্ঠানে নিজের সেই প্রকৌশল–জীবনের গল্পই শোনালেন এ সময়ের জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রী।

তাপসী পান্নু
ছবি: তাপসীর ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

কয়েক বছর আগেও আমি তোমাদের জায়গায় ছিলাম। ভারতে রীতিটা এমন—এখানে আমরা প্রকৌশলী হওয়ার পর ভাবতে বসি, জীবনে কী হব। আমিই এর বড় উদাহরণ। হ্যাঁ, আমি একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। প্রশ্ন করতে পারো, কেন প্রকৌশলে পড়েছিলাম? কারণ, আমার গণিত ভালো লাগত। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় যখন গণিতে ৯৬-৯৭ পেতাম, ধরেই নিয়েছিলাম—প্রকৌশলই হতে পারে আমার একমাত্র গন্তব্য।

ভর্তি হতে গিয়ে শুরুতেই অবশ্য ধাক্কা খেলাম। কিছু নম্বর, কিছু র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকার কারণে প্রথম সারির প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পেলাম না। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাতে কি? আজ তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি (হাসি)!

ইঞ্জিনিয়ার কি হতে পারব?

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বর্ষে একটা ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খেত—আমি কি নিজেকে এখানে দেখতে চেয়েছিলাম? দ্বিতীয় বর্ষে আমার উপস্থিতির হার কমতে শুরু করল। পড়ালেখার বাইরে অন্য নানা দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করলাম। ক্যাম্পাসের মেয়েদের নিয়ে একটা ডান্স ক্লাব চালু করে ফেললাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা এমনিতেই সংখ্যায় কম। সেখানে ক্লাবে ১০ জন সদস্য পাওয়াই এক বিরাট অর্জন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটাকে উপভোগ্য করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ভাবলাম, এসেই যখন পড়েছি, মাঝপথে তো ছেড়ে দিতে পারি না।

দ্বিতীয় বর্ষ কোনোরকম কেটে গেল। তৃতীয় বর্ষে একজন বলল, ‘তুমি তো দেখতে ভালোই। মডেলিংয়ের চেষ্টা করছ না কেন?’ বললাম, ‘আচ্ছা! তো সে জন্য কী করতে হবে?’

পোর্টফোলিও তৈরি করে পাঁচ-ছয় মাস ধরে দিল্লির বিভিন্ন বড় ব্র্যান্ডের কাছে ধরনা দিতে থাকলাম। বাবার শুধু দুটি শর্ত ছিল। রাতে বাইরে থাকা যাবে না এবং দিল্লির বাইরে যাওয়া যাবে না। বাবা ভয়ে ছিলেন, আমি হয়তো প্রকৌশলের পড়ালেখাটা শেষ করতে পারব না।

তাপসী পান্নু
ছবি: তাপসীর ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

দেখব কীভাবে পাস করো!

তৃতীয় বর্ষে বেশ কিছু মডেলিং করলাম। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক আসা শুরু হলো। বেশির ভাগ ডাকই আসত দক্ষিণ ভারত থেকে। তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল, আমি দেখতে বেশ কিউট! আর এ কারণেই নাকি ভালো অভিনয়ও পারব। বললাম, আমি তো ভাষা জানি না। তারা বলল, ‘সেটা কোনো সমস্যা না। এখানকার ৯০ শতাংশ নায়িকাই দক্ষিণি ভাষা জানে না। আমরা তাঁদের শিখিয়ে নিই।’ মনে হচ্ছিল আমার ওপর আমার চেয়ে তাঁদের আস্থাই বেশি। বললাম, ঠিক আছে। এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত ইঞ্জিনিয়ারিংটা আমাকে শেষ করতে দিন। নইলে বাবা বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না।

চতুর্থ বর্ষটা ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। তোমরা অনেকেই বোধ হয় এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে পরিচিত। অনেক সময় যেমনটা হয়, শিক্ষক বলেন, ‘দেখব তুমি কীভাবে পাস করো!’ আমার বেলায়ও তা–ই হয়েছিল। বিভাগীয় প্রধান বলেছিলেন, ‘তোমার উপস্থিতির যা হার! তুমি তো মডেলিং, নাচানাচি, পাবলিক স্পিকিং, এসব নিয়েই ব্যস্ত। তার ওপর তোমার চুল লাল। ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্টে তোমাকে দেখে নেব।’

আমাদের অ্যাপ

আমার আরও দুই বান্ধবীও এ রকম ‘ওয়ার্নিং’ পেয়েছিল। লাল চুলের জন্য নয়, অন্য কারণে। তো আমরা তিনজন ভাবলাম, চলো এমন কিছু বানাই, যেন শিক্ষকেরা আমাদের কোনো প্রশ্নই করতে না পারে। তিনজন মিলে আইফোনের জন্য একটা অ্যাপ বানিয়ে ফেললাম। নাম ফন্টসোয়্যাপ। এই অ্যাপ দিয়ে আইফোনের চারটা ফন্টই বদলে ফেলা যেত। ‘অবজেক্টিভ সি’ ব্যবহার করে আমরা অ্যাপটা বানিয়েছিলাম।

এটা ২০১৩-১৪ সালের কথা। বুঝতেই পারছ, তখন আইফোনের অ্যাপ সম্পর্কে আমাদের অধ্যাপকদের খুব একটা ধারণা ছিল না। যত দূর মনে পড়ে, সেবার আমরা ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় সেরা প্রজেক্টের স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। আমার ধারণা, আমরা কী বানিয়েছি, অনেকে সেটা বুঝতেই পারেনি (হাসি)।

মজার ব্যাপার হলো, আমার প্রথম তামিল ছবি করার সময় জানলাম, দক্ষিণি নায়ক ধানুশ এই অ্যাপ ব্যবহার করে। অ্যাপটা আমি বানিয়েছি শুনে ও প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। ‘আচ্ছা! দিল্লির সরদারনি, এই অ্যাপ তুমি বানিয়েছ?’ এসব বলে আমাকে খেপাচ্ছিল। বললাম, ‘অ্যাপের অ্যাবাউট সেকশনে গিয়েই দেখো।’

অ্যাপ নির্মাতাদের মধ্যে সত্যিই আমার নাম দেখে রীতিমতো থতমত খেয়ে গিয়েছিল বেচারা। ধানুশকে দোষ দেব না। একটা অ্যাপ বানানোর পেছনে আমার অবদান আছে শুনে অধিকাংশ লোকই অবিশ্বাস নিয়ে তাকায়।

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই আমি ইনফোসিসে চাকরি পেয়েছিলাম। শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ দিতে আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিল ওরা। তবে আমি আবেদন করেছিলাম চাকরি করার জন্য নয়, বাবার কাছে প্রমাণ করার জন্য যে আমি পারি।

এক বছরে সাত সিনেমা

প্রকৌশলের পড়ালেখা শেষ করার পর ক্যাট (কমন অ্যাডমিশন টেস্ট) দিলাম। নম্বর খুব একটা ভালো এল না। ভাবলাম, সামনের বছর আবার পরীক্ষা দেব। কিন্তু এই এক বছর কী করব? আমি তো এক বছর বসে থাকার লোক নই। সে সময়ই আমি ছয়টি জাতীয় পুরস্কার পাওয়া তামিল ছবি আদুকালামে অভিনয় করি। (করতালি) আপনাদের করতালির জন্য ধন্যবাদ, তবে জানিয়ে রাখি, ছয়টি পুরস্কারের একটিও আমি পাইনি।

৩ বছরের মধ্যে আমি ১৫টা ছবিতে অভিনয় করে ফেললাম। একই বছরে সাতটা ছবি মুক্তি পেয়েছিল। তখন মনে হলো, আমি আসলে কী করছি? সকালে এক ছবি, সন্ধ্যায় আরেক ছবিতে অভিনয় করছি। এটাকে কি অভিনয় বলে? আমি কি এটা উপভোগ করছি? আমার তো লক্ষ্য ছিল এমবিএ করা। তার বদলে ১৫টা সিনেমা করে বসে আছি! ব্যাপারটা হজম হচ্ছিল না।

এই সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই আমার প্রথম হিন্দি ছবি চাশমে বাদ্দুর–এ অভিনয় করলাম। ভাগ্যিস এ ছবির জন্য আমাকে কোনো অডিশন দিতে হয়নি। কারণ, আজ পর্যন্ত কোনো অডিশনে আমি টিকতে পারিনি। অবশ্য যেসব ছবির জন্য অডিশন দিয়েছি, সেগুলোও খুব একটা টেকেনি। নাম বলব না, বললে সম্ভবত চিনতেও পারবে না।

সব সময় একটা দ্বিতীয় পরিকল্পনা রাখো

হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করার পর পুরো ভারত আমাকে চিনে ফেলল। তখন মনে হলো, এবার আমার একটা পরিকল্পনা করা উচিত। অতএব পরিকল্পনা করলাম—আমাকে ধীরে চলতে হবে। একটা কথা সত্যি, কখনোই আমি টাকার জন্য কাজ করিনি। বাবা বলেছিলেন, টাকার জন্য সিনেমায় নেমো না। যত দিন উপভোগ্য মনে হবে, তত দিন কাজ করো। ভালো না লাগলে ফিরে এসো। নিশ্চয়ই তোমার জন্য অন্য অনেক পথ আছে। এই আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যেও ছিল।

বেছে বেছে কাজ করতে শুরু করলাম। এটা আমার জন্য খুব কাজে দিল। ছবি হিট হতে থাকল। দেখা গেল আমার হাতে অনেক সময়। ভাবলাম অভিনয়ের পাশাপাশি একটা কিছু করি। সারা জীবন তো আর অভিনয় করব না। এভাবেই শুরু হলো আমার ‘ওয়েডিং প্ল্যানিং’–এর উদ্যোগ। এখন ব্যবসাটা ভালোই চলছে।

আমার জীবনে কখনোই তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। জীবনের ‘প্ল্যান এ’ সব সময় ভাগ্যই ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু ‘প্ল্যান বি’ ঠিক করেছি আমি। এবং এটা নিশ্চিত করেছি, যেন ‘প্ল্যান বি’-তেও আমি শক্ত অবস্থানে থাকি। তাই তোমাদের বলব, যত রকম সুযোগ পাও, লুফে নাও। কিন্তু সব সময় একটা দ্বিতীয় পরিকল্পনা (প্ল্যান বি) রাখো। ‘প্ল্যান বি’ তোমাকে ‘প্ল্যান এ’ সফল করতে সাহস জোগাবে।

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও