পড়াশোনার পাশাপাশি ঈদে লাখ টাকার ব্যবসা করেছেন এই শিক্ষার্থীরা

পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট-বড় উদ্যোগ নিয়ে আয় করছেন অনেক শিক্ষার্থী। ঈদ ঘিরে তাঁদের আছে বাড়তি আয়োজন ও প্রস্তুতি। কয়েকজনের খোঁজ নিয়েছেন ফুয়াদ পাবলো

সারা দেশে আউটলেট দিতে চান সামিহা

তখনো মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হননি সালসাবিল সামিহা। এরই মধ্যে মাথায় চাপে ব্যবসার ঝোঁক। কিসের ব্যবসা করবেন, টাকা কোথায় পাবেন—ভাবতে ভাবতেই একটা ‘আইডিয়া’ মাথায় আসে। ছবি আঁকা ও ছবি তোলার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কাঠের গয়নায় রং করে সেগুলো ফেসবুকে দিতে শুরু করেন। অল্প দিনেই পেয়ে যান অবিশ্বাস্য সাড়া। একসময় অর্ডার নিতে শুরু করেন। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর কাজ শুরু করেন পুরোদমে। সামিহার এই উদ্যোগ বর্তমানে আহর্সি নামে পরিচিত। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে প্রথম বর্ষে পড়েন এই উদ্যোক্তা।

সামিহা জানালেন, আহর্সিতে এখন তাঁর নকশা করা ব্লক ও এমব্রয়ডারি শাড়ির পাশাপাশি কাঠের গয়নাও পাওয়া যায়। বলছিলেন, ‘নিয়মিত ব্যবহারের জন্য কেউ চাইলে কামিজ সেট নিতে পারেন। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে ব্লাউজের কাপড়, পাঞ্জাবি, বেবি স্টিচড শাড়ি, ফ্রক ও বাচ্চার কামিজও কাস্টমাইজ করে নিতে পারেন ক্রেতারা।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে প্রথম বর্ষে পড়েন এই উদ্যোক্তা
ছবি: সংগৃহীত

এখন দেশের বাইরে থেকেও নাকি নিয়মিত অর্ডার পাচ্ছেন সামিহা। কিন্তু বিদেশে পণ্য পাঠানোসহ পুরো প্রক্রিয়াটাই বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেন? সামিহা বলেন, ‘শুরুতে বিদেশ থেকে পাওয়া অর্ডারগুলো ক্রেতার পরিবারের মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করতাম। এভাবে অনেকগুলো অর্ডার নিয়েছি। কিন্তু সব সময় তো এভাবে সম্ভব নয়। ২০২১ সালে আমার ফেসবুক পেজে একটু সমস্যা হয়েছিল। তখন একটা বিকল্প পেয়ে যাই। আদি নামে একটা ওয়েবসাইট সম্পর্কে জানতে পারি। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের বাইরে পণ্য পাঠানো যায়। অ্যাকাউন্ট খোলার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একটা ব্লকের কুশন কভারের অর্ডার আসে। এর পর থেকে নিয়মিতই ওদের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নেপালসহ নানা দেশ থেকে অর্ডার এসেছে। দেশের বাইরে আমি প্রায় ২০০ পণ্য পাঠিয়েছি।’

এই ঈদে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন বলে জানালেন সামিহা। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এরই মধ্যে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন প্রথম বর্ষে পড়া এই শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে রিন নামকরা নারী, ২০২৩ সালে ফেমফেস্ট, ২০২৪ সালে এন্ট্রাপ্রেনিউরস ফেস্ট থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। বর্তমানে অনলাইনে ব্যবসা করলেও ভবিষ্যতে সারা দেশে নিজের পণ্যের আউটলেট দিতে চান সামিহা। বলছিলেন, ‘দেশের বাইরে আরও বড় পরিসরে পণ্য বিক্রি করতে চাই। এ ছাড়া আস্তে আস্তে সারা বাংলাদেশে আহর্সির আউটলেট করতে চাই। কারণ, ক্রেতারা হাতে ধরে, দেখে পণ্য নিতে চান।’

২০ লাখ ছাড়িয়েছে অন্তরদের বিক্রি

চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকায় জন্ম আশরাফ অন্তরের। বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাছ থেকে দেখে ছোটবেলা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ঈদ বা পয়লা বৈশাখের মতো উৎসব এলে কার্ড বা এ ধরনের ছোটখাটো উপহার বিক্রি করতেন। কিন্তু ইচ্ছা ছিল আরও বড় কিছু করবেন। মহামারির সময় সেই সুযোগটাই হয়ে যায়।

কনটেন্ট নির্মাতা দাউদ কিমের হাতে নিজের তৈরি পণ্য তুলে দিয়েছেন অন্তর
ছবি: সংগৃহীত

অন্তর তখন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে স্কুলজীবনের বন্ধু শাহেদকে সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যবসার পরিকল্পনা করেন তিনি। পারিবারিকভাবে শাহেদদের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। দুই বন্ধু মিলে যখন একটা কিছু করার সুযোগ খুঁজছেন, তখনই ফেসবুকের একটা গ্রুপে চোখ পড়ে—গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের জন্য থান কাপড় আর পাঞ্জাবি চাই। সাহস করে অর্ডার নিয়ে ফেলেন অন্তররা। সাফল্যের সঙ্গে গ্রাহকের হাতে পৌঁছেও দেন। সেই শুরু।

তখনো অবশ্য অন্তরদের ব্যবসার কোনো নাম ছিল না। শাহেদের পরামর্শে ব্র্যান্ডের নাম ঠিক হলো ‘সেই রং’। গায়েহলুদ, বিয়ে ও উৎসবগুলোর পুরোনো রীতি মনে করিয়ে দিতেই এমন নামকরণ।

বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কিছু জেলা শহরে পাইকারি হিসেবে পণ্য সরবরাহ করছেন অন্তর। পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির ফরমাশও পাচ্ছেন তিনি।

ব্যবসায় প্রশাসনের এই ছাত্র বলছিলেন, ‘আমি সব সময় অনলাইন মার্কেটপ্লেসের ওপর বিশ্বাস রাখতে চেয়েছি। ক্রেতাদের ফিডব্যাক মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছি।’ এবারের ঈদে এখন পর্যন্ত ২০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করেছেন অন্তর। যেভাবে সাড়া পাচ্ছেন, তাতে সংখ্যাটা ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে তাঁর ধারণা। চট্টগ্রামের একটি মার্কেটে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে দোকানও দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষভাবে মোট ১২-১৫ জন, পরোক্ষভাবে ২০-২৫ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এই তরুণের মাধ্যমে হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে-বিদেশে ব্যবসাটিকে একটি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে দাঁড় করাতে চান তিনি।

ব্যবসায় স্বাবলম্বী হয়েছেন আরুবা

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহই আরুবা তাসনিমকে চারুকলায় পড়তে সাহায্য করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তির পর থেকেই কোর্সওয়ার্কগুলো করার পাশাপাশি নিজের মনের মতো ব্যাগ, জুতা ও জামা রাঙাতে শুরু করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব পোস্ট করতেই আশপাশের পরিচিতজনের কাছ থেকে আসতে শুরু করে প্রশ্ন—‘কীভাবে পাব?’ ‘কত দাম?’ বলা যায় মানুষের চাহিদাই আরুবাকে ব্যবসায়ী বানিয়েছে। এভাবেই জন্ম নেয় তাঁর উদ্যোগ ‘আরিন্দা’।

ব্যবসাটা দেশের বাইরেও পৌঁছে দিতে চান তরুণ এই উদ্যোক্তা
ছবি: সংগৃহীত

আরিন্দায় এখন হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি, সালোয়ার–কামিজ, স্কার্ফ, কাফতান, স্কার্ট, পাঞ্জাবি, লেহেঙ্গা, কুর্তি ও কাস্টমাইজড বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক পাওয়া যায়। মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন এই শিক্ষার্থী। যদিও এখনই নিজেকে পুরোপুরি সফল বলতে তিনি নারাজ। তবে আজকের এই পর্যন্ত আসার পেছনে নিজের ইচ্ছাশক্তি আর কাছের মানুষদের সহযোগিতার কথাই জোর দিয়ে বললেন। অনেক সময় নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। পরিবারের সহায়তা ছিল বলেই উতরে যেতে পেরেছেন তিনি।

চারুকলায় ব্যবহারিক কাজ বেশি হওয়ায় ব্যবসা সামলাতে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে পড়ালেখা আর কাজের ধরনে মিল থাকায় বেশ সুবিধাও পেয়েছেন। সঙ্গী হয়েছেন আরও তিন শিক্ষার্থী।

ঈদ উপলক্ষে নতুন বেশ কিছু নকশা করেছেন আরুবা। সবগুলো এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে বলে জানালেন।

ব্যবসাটা দেশের বাইরেও পৌঁছে দিতে চান তরুণ এই উদ্যোক্তা। বলছিলেন, ‘চারুকলায় পড়া শিক্ষার্থীদের ছোট করে দেখা হয় অনেক সময়! আমি চাই, যেন আমার মতো যারা নিজের একটা উদ্যোগ শুরু করার চেষ্টা করছে, তাদেরকে সবাই চিনুক। সাহায্য করুক। যেন পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবতে না হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে—একাডেমিক পড়াশোনাটা যেন ঠিক থাকে।’

ক্রীড়াঙ্গনে সহযোগী হতে চান তানভীর

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ফুটবল বিভাগে প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন তানভীর সিদ্দিকী। করোনাকালে খেলাধুলা যখন বন্ধ, একটা কিছু করার কথা ভাবছিলেন তিনি। নিজে যেহেতু খেলোয়াড়, তাই একটা স্পোর্টস ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন। এভাবেই তানভীরের উদ্যোগ—ওয়েরিক্সের যাত্রা শুরু।

বর্তমানে টি–শার্ট, পোলো টি–শার্ট, ট্রাউজার, শর্টস, থ্রি-কোয়ার্টার ও জার্সি বিক্রি করেন তানভীর। দেশ ও দেশের বাইরে তাঁর তৈরি পণ্যের বেশ চাহিদা আছে। এই ঈদেই যেমন এখন পর্যন্ত ১৬ লাখ টাকার বেশি বিকিকিনি হয়েছে বলে জানালেন।

ব্যবসার সুবাদেই পাকিস্তানি ক্রিকেটার বাবর আজমের সঙ্গে দেখা হয়েছে তানভীরের
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়েন তানভীর। পড়াশোনা, খেলাধুলা ও ব্যবসা—সব একসঙ্গে কীভাবে সামলান? কাজটা কঠিন, সেটা তানভীরও মেনে নিলেন। খেলাধুলায় যেমন এখন খানিকটা বিরতি দিয়েছেন। ব্যবসার জন্য মাঝেমধ্যে ক্লাসও মিস হয়ে যায়। কিন্তু হাল ছাড়তে চান না তিনি। তানভীরের ব্যবসার সুবাদে এখন ১৩ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। নিজের পাশাপাশি তাই এই মানুষগুলোর কথাও তাঁকে ভাবতে হয়।

ক্রীড়াজগতে ব্যবসার অনেক সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন তানভীর। বলছিলেন, ‘আমাদের দেশে ক্রীড়াসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা আছে। কয়েক বছরের মধ্যে এটা বিলিয়ন ডলারের মার্কেট হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও আমরা দেশে অনেক কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারি না। বিদেশ থেকে আমদানি করতেও নানা জটিলতা। এসব দিকে সরকার নজর দিলে আমরা আরও ভালো করতে পারব।’

আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনার কথাও বললেন, ‘১০ বছরের মধ্যে ওয়েরিক্সকে একটা গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমি নিজে যেহেতু একজন খেলোয়াড়, ব্যবসার মাধ্যমে আমি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সহযোগী হতে চাই। এ বছর বাংলাদেশ প্রমীলা ফুটবল লীগে আমি নাসরিন স্পোর্টস একাডেমির কিট স্পনসর করেছি। সাফজয়ী স্বর্ণকন্যারা এই দলে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আমার ব্র্যান্ডের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন।’