মোটরসাইকেলেই স্বচ্ছন্দ পাহাড়ের নারীরা

পাহাড়ের অনেক কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী নারীর যাতায়াতের প্রধান বাহন এখন মোটরসাইকেলছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

মুক্তা চাকমা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা। প্রতিদিন তাঁকে সন্তানদের স্কুলে আনা–নেওয়া থেকে শুরু করে অফিসসহ বিভিন্ন পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়। তিনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানে সব সময় টমটম বা রিকশা পাওয়া যায় না। প্রতিদিনের যাতায়াত ঝামেলা এড়াতে ছয় বছর আগে একটা স্কুটি কিনেছেন মুক্তা। চালানো শিখতে লেগেছে তিন দিন। সেই থেকে স্কুটিই এখন তাঁর প্রতিদিনের চলার সঙ্গী।

মুক্তা চাকমার মতোই আরেক কর্মজীবী নারী দলিপ্রু মারমা। ১ নং নুনছড়ি প্রকল্প সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। থাকেন খাগড়াছড়ি শহরে। স্কুটি চালিয়েছেন আট বছর। বর্তমানে চালাচ্ছেন একটা ইয়ামাহা। তিনি বলেন, প্রতিদিন টমটমের জন্য অপেক্ষা, এরপর বাস, মাহিন্দ্র অথবা পিকআপের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা। গাড়ি থেকে নামার পর আবার ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল। প্রায় সময় অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করতে হতো। তাই  স্কুটি কেনার সিদ্ধান্ত নিই। এখন সময়ও বাঁচে আর স্বচ্ছন্দও চলতে পারি।

একসময় পাহাড়ে শুধু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নারী কর্মীরাই স্কুটি চালাত। তাও হাতে গোনা কয়েকজন। সময় বদলেছে। পাহাড়ের অনেক কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী নারীরা এখন স্কুটি ব্যবহার করছেন। গণপরিবহনের চেয়ে ঝামেলা কম। অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের জন্য দিন দিন
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্কুটি। কর্মজীবী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুটি এখন বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন। তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যাতায়াতের সময় অনেকে হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলায় কতজন নারী এখন মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে এই সংখ্যা দুই শতাধিকের ওপর হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপণনকেন্দ্রের কর্মকর্তারা। খাগড়াছড়িতে প্রথম যে কজন নারী মোটরসাইকেল চালাতেন, তাঁদের একজন সিগ্ধা চাকমা। তিনি বলেন, ২২ বছর আগে আমি মোটরসাইকেল চালাতাম। সে সময় জেলায় হাতেগোনা তিন-চারজন নারী মোটরসাইকেল চালাত। তখন সবাই এমনভাবে তাকাত যেন এই বাহন শুধু পুরুষদের জন্য তৈরি হয়েছে। এখন রাস্তায় বের হলেই নারীদের স্কুটি চালাতে দেখা যায়। দেখতে ভালোই লাগে। নারীদের এগিয়ে আসাকে সাধুবাদ জানাই, আরও এগিয়ে আসতে হবে। তবে হেলমেট পরা এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক।

খাগড়াছড়ি ইয়ামাহা কোম্পানির ডিলার অভি মোটর্সের পরিচালক ইমরান হোসেন বলেন, আগে মাসে ৪ থেকে ৫টি বিক্রি হতো। তবে এই বছর কম বিক্রি হচ্ছে। এ মাসে স্কুটি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩টি। কোন নারী স্কুটি কিনতে আসলে আমরা তাদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করে থাকি। সেলিম মার্কেটের হিরো হোন্ডা বিক্রয়কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী সুদর্শন দত্ত বলেন, তিনি কর্মজীবী নারীদের কাছে সহজ কিস্তিতে স্কুটি বিক্রি করে থাকেন।

তবে স্কুটি চালাতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন নারী। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করেন খাগড়াছড়ির মুন্না চাকমা। তিনি বলেন, ব্যবসা এবং রাজনীতি করার কারণে প্রতিদিন বিভিন্ন উপজেলায় যেতে হয় আমাকে। সময়মতো গাড়ি পাওয়া যায় না। অনেক সময় লোকজনের সঙ্গে শেয়ারে যেতে হয়। স্কুটি কেনার পর থেকে যখন যেখানে ইচ্ছে যেতে পারছি। এর চাইতে সুবিধা আর কোথায় পাব। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যাপারে নারীদের যদি হয়রানি করা না হয়, তাহলে সুবিধা হতো।

নৃত্যশিল্পী রিয়া চাকমা জানান, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারনে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় আসা-যাওয়া করতে হয়। অনুষ্ঠান থাকে। গাড়ির অভাবে আগে সময় মতো পৌঁছাতে পারতাম না। এ ক্ষেত্রে স্কুটি খুব কাজে দেয়। আগে যেখানে যেতে ৪০ টাকা প্রয়োজন হতো, এখন ২০ টাকার তেলে সেখানে হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে রাস্তায় হয়রানি শিকার হতে হয়।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার বলেন, এখনো পর্যন্ত কোন নারী হয়রানি হয়েছেন বলে অভিযোগ নেই। তবে কেউ ইভটিজিং বা
হয়রানির অভিযোগ নিয়ে আসলে গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।