কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট কারা, জানেন?
সব মানুষের কথা বলার ধরন এক নয়। কেউ একটু ভেবেচিন্তে কথা বলেন, যাতে অপর পক্ষ মনে কষ্ট না পায়। কেউ আবার নিজের মনের কথা নিজের মতো করে প্রকাশ করতেই পছন্দ করেন। তাতে কার কী মনে হলো, সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেন না। এ ধরনের মানুষের মধ্যেই কেউ কেউ ‘কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট’ বা আত্মপ্রেমী আলাপচারী।
অন্যের সামনে নিজের ভালো দিক প্রকাশ করতে চাইতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে তা যদি অহমিকার পর্যায়ে চলে যায়, তাহলেই মুশকিল। একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট অন্যের অনুভূতি খেয়াল না করে নিজের কিংবা নিজের কাছের মানুষের অর্জন বা সাফল্যের গল্প বারবার সামনে নিয়ে আসেন। তাঁদের কথায় আত্মঅহমিকা প্রকাশিত হয়। কনভারসেশনাল নার্সিসিস্টের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষক হাজেরা খাতুন।
নিজেকে জাহির
একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট অন্যের সামনে নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করেন। যেকোনো প্রসঙ্গে আলাপের ক্ষেত্রে তাঁর নিজেকে সেরা হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা থাকে। ব্যাপারটা প্রায় সব সময়ই নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়, যা শোভনীয় পর্যায়ে থাকে না। আর এমন আলাপচারিতা তিনি নিয়মিত চালিয়ে যান।
অন্যকে গুরুত্ব না দেওয়া
নিজের কথা বলতে গিয়ে অন্যদের মনোভাব বা অনুভূতি মূল্যহীন হয়ে পড়ে তাঁর কাছে। অন্যের কথা শোনার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেন না তিনি। অথচ তাঁদের একই ধারার কথা শুনতে শুনতে অন্যরা প্রায়ই বিরক্ত বোধ করেন। আবার কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট অনেক সময় এমনভাবে নিজের কথা বলতে থাকেন, যাতে অন্য কেউ কষ্টও পেতে পারেন, বিশেষ করে যখন ওই বিষয়ে কারও দুর্বলতা থাকে কিংবা না পাওয়ার কষ্ট থাকে। ধরা যাক, এক দম্পতির সন্তান নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাননি; তাঁদের পরিচিত গণ্ডির ভেতর একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট আছেন। এই ব্যক্তির চেনাজানা কেউ হয়তো ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ওই দম্পতির সামনে তিনি ইচ্ছা করে এই প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এতে যে তাঁরা কষ্ট পেতে পারেন, তা তিনি উপলব্ধিও করেন না।
গুরুত্ব পাওয়ার প্রবণতা
অন্যকে গুরুত্ব না দিলে কী হবে, অন্যের কাছ থেকে ঠিকই গুরুত্ব আশা করেন একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট। অন্যকে হেয় করে হলেও নিজে চান অন্যের প্রশংসা। নিজেকে তিনি এমনভাবে প্রকাশ করতে চান, যাতে সবাই তাঁকে বিশেষ কেউ মনে করেন।
আলাপচারিতা নিয়ন্ত্রণ
আলাপচারিতার গতি যদি এমন দিকে যায়, যেখানে তিনি নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাহলে নিজেই আলাপচারিতার গতি বদলে দেন। কথার গতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের দিকেই নিয়ে আসেন। মোটকথা, নিজেকেই সেরা হিসেবে প্রকাশ করার সুযোগ তৈরির চেষ্টায় থাকেন একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট।
একজন মানুষের এমন বৈশিষ্ট্য তাঁর জীবনে কী প্রভাব ফেলে, আর এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী, সে সম্পর্কেও জানালেন হাজেরা খাতুন।
সম্পর্কে প্রভাব পড়ে
একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্টের আচরণ তাঁর সামাজিক সম্পর্কগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকেই তাঁর ওপর বিরক্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ তাঁকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। ভদ্রতার খাতিরে সম্পর্ক বজায় রাখলেও অন্যের কাছে ওই ব্যক্তি তাঁর স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা হারান। তাঁর প্রতি অন্যদের আস্থা কমে যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। এমনকি বন্ধু কিংবা জীবনসঙ্গী তাঁর আচরণে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন। সঙ্গী তাঁর কারণে অসুখী জীবন যাপন করেন। জীবনসঙ্গী কিংবা বন্ধুদের কেউ কেউ অতিষ্ঠ হয়ে এমন ব্যক্তিকে ছেড়েও চলে যেতে পারেন।
সংশোধনের উপায়
আমাদের চারপাশে অনেকেই কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট। তবে বাস্তবতা হলো, তাঁদের অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারেন না যে তাঁর আলাপচারিতার এই ধরন ভালো নয়। অন্যের বিরক্তি বা কষ্টের অনুভূতিটা তাঁরা অনুভব করতে পারেন না। আর অন্যরাও অনেক সময়ই ধরে নেন যে, এই মানুষটার হামবড়াই ভাব কখনো যাবে না। তাই তাঁরাও ওই ব্যক্তিকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলেন না। আর অন্য কেউ সচেতন করতে চাইলেও অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই একজন কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট সেই কথাটিকে গুরুত্ব দেন না। সব মিলিয়ে তাঁর নিজের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠাটাই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আর তাই সংশোধনও মুশকিল।
তবে আপনজনদের দীর্ঘদিনের প্রতিক্রিয়া থেকে কিংবা বারবার কাছের মানুষের দূরে চলে যাওয়ার ঘটনা থেকে কোনো কোনো কনভারসেশনাল নার্সিসিস্ট উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর নিজের আচরণের কোথাও কোনো সমস্যা আছে। তাঁর এই আত্মঅহমিকা প্রকাশের মাত্রা খুব গুরুতর পর্যায়ের না হলে, সে ক্ষেত্রে তিনি নিজের কথাবার্তার ধরনকে সংযত করে নিতে পারেন। তখন তিনি অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে চেষ্টা করেন। এভাবে একটু একটু করে নিজেকে বদলে ফেলতে পারেন। তবে সমস্যাটি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে গেলে মনোবিদের সহায়তা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।