শিল্পী নাফিসের ক্যামেরায় বাবুলদের ঘুড়ির জীবন

খুব বেশি পড়াশোনার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি বাবুলের। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন মাদারীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের স্থানীয় হাইস্কুলে। তারপর জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। সেখানে কেটেছে ১১ বছর। কনটেইনারের কাজ করতে গিয়ে ঘাড় ও কোমরে ব্যথা পান। তারপর আর সেখানে থাকতে পারেননি।

দেশে ফিরে মন টিকছিল না। কাজও পাচ্ছিলেন না। পৈতৃক জমি বিক্রি করে এবং পরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ধারদেনা করে ১১ লাখ টাকা তুলে দেন দালালের হাতে। সেই দালাল কথা দিয়েছিল, পুরো পথ প্লেনে পাড়ি দিতে হবে, কেবল ৩০ মিনিট সাগরে। ব্যস, স্বপ্নের স্পেন!

শিল্পকলায় চলছে ১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী, সেখানেই দেখানো হচ্ছে নাফিসের ‘কাইটস’
ছবি: প্রথম আলো

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, স্পেনে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল বেশ কয়েক মাস। প্রথমে ভারত, সেখান থেকে ১৫ দিনের ভিসা নিয়ে আলজেরিয়া। তারপর হেঁটে পাহাড় পাড়ি দিয়ে সাত দিনে মরক্কো। রাত হলে হাঁটা শুরু করতেন তাঁরা। অন্ধকার থাকতে থাকতে হেঁটে পাহাড় পাড়ি দিতেন। প্রতিটি পাহাড় পাড়ি দিতে সাত ঘণ্টার মতো সময় লাগত। খাবার নেই, পানি নেই, বিশ্রাম নেই। হাঁটার গতি কমে এলে মাফিয়ারা মারধর করত। এরই মধ্যে আবহাওয়া খারাপ থাকায় এক মাফিয়ার বাসায় এক মাস ছয় দিন ছিলেন। এরপর ‘গেম দেন’। ‘গেম দেওয়া’ মানে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেওয়া। সব সময় সাফল্যে পৌঁছানো যায় না। যেমন বাবুলদের গেম দিতে সময় লাগার কথা ছিল এক ঘণ্টা, বাস্তবে সময় লেগেছিল ১৪ ঘণ্টা। এরপর ধরা পড়েন সেনাবাহিনীর হাতে। সেখান থেকে নানা গল্পের মোড় ঘুরে কোনো কাগজপত্র ছাড়া তিনি জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন এক ‘অদৃশ্য মানুষ’ হিসেবে।

স্পেনে তখন ছিলেন বাংলাদেশি ভিজুয়াল আর্টিস্ট গাজী নাফিস আহমেদ। নাফিস সেখানে ছিলেন দ্য অ্যান্ড্রু ডব্লিউ মেলন ফাউন্ডেশনের একটা অ্যাওয়ার্ড নিয়ে, এক বছরের আর্টিস্ট রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে। বাবুলের সঙ্গে কীভাবে দেখা? নাফিস বললেন, ‘আমাদের ঢাকায় যেমন পুরান ঢাকা আছে, স্পেনেও ওল্ড মাদ্রিদ, ওল্ড বার্সেলোনা আছে। এই এলাকাগুলোতে মূলত বাঙালিরা থাকেন। এখানে বাঙালি খাবারের দোকান আছে। তাই বার্সেলোনায় থাকার সময় আমি প্রায়ই দেশি খাবার চেখে দেখতে ওই এলাকাগুলোতে ঢুঁ দিতাম।’

সে রকম একদিনে নাফিস যান ওল্ড বার্সেলোনার একটা খাবারের দোকান ‘মধুর ক্যানটিন’–এ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যানটিনের নামকরণে এক বাঙালি ওখানে ওই রেস্টুরেন্ট খোলেন। সেখানে বাবুলের সঙ্গে নাফিসের পরিচয়। এটা ২০১৯ সালের কথা। নাফিস বাবুলকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাবুলের বাড়িতে যান। এরপর সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে বানান বাবুলের স্পেনযাত্রা ও সেখানকার জীবনের ওপর ৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের একটি প্রামাণ্যচিত্র, নাম ‘কাইটস’।

কাইটস দেখছেন আগত দর্শনার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

প্রামাণ্যচিত্রের নাম কেন কাইটস? এর উত্তরে নাফিস বললেন, ‘বাবুলের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। বাবুল বলেন যে তাঁদের জীবন ঘুড়ির মতো। সব সময় উড়তে হয়। না হলে টুপ করে পড়ে যেতে হয়। কথাটা মনে ধরল। তাই সেখান থেকে আমার কাজটার নাম দিলাম কাইটস। বাবুল একা নন, এখানে বেশির ভাগ অভিবাসী বাঙালির কোনো কাগজপত্র নেই। তাঁরা বেআইনিভাবে কাজ করেন, দেশে টাকা পাঠান আর পুরো সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। বাবুল এসব মানুষের প্রতিনিধি।’
স্পেনে গিয়ে বাবুল একটি পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন। সেখানে প্রথম মাসে ৪০০ ইউরো বেতন দিলেও পরের মাস থেকে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বেতন চাইলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হতো। বাধ্য হয়ে বাবুল নিজেই একটা ব্যবসা শুরু করেন। বাঙালি দোকান থেকে ছোটখাটো নানা স্যুভেনির কিনে সেগুলো সমুদ্রের ধারে পর্যটকদের কাছে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেন।

তিন বছর পার হলে কাগজপত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন বাবুল। এই সময়ের মধ্যে স্পেনে থাকা, কাজ করা—সবই আইনবিরোধী। যেকোনো সময় ধরা পড়তে পারেন পুলিশের হাতে। বাবুলের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি দেখতে পারেন দক্ষিণ এশিয়ার চারুকলার সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ‘এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল’–এর ১৯তম আসরে। সেখানে নানা আলোকচিত্রের সঙ্গে এলইডি টিভিতে দেখানো হচ্ছে এই প্রামাণ্যচিত্র। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেখা যাবে এই প্রদর্শনী।

শিল্পী গাজী নাফিস আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

শিল্পী গাজী নাফিস আহমেদ বাংলাদেশে ও লেভেল এবং এ লেভেল শেষ করে আর্ট, মিডিয়া অ্যান্ড ডিজাইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান যুক্তরাজ্যের লন্ডনের গিল্ডহল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ডেনমার্কের ড্যানিশ স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম থেকে তিনি ফাইন আর্টসে স্নাতকোত্তর করেন। স্পেনের মাদ্রিদের লেন্স স্কুল অব ভিজুয়াল আর্টস থেকে সিনে ডকুমেন্টাল বিষয়েও স্নাতকোত্তর করেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে শিল্পের নানা মাধ্যম নিয়ে কাজ করছেন গাজী নাফিস আহমেদ।