যে ঘরটি মা সাময়িক ইবাদতখানা বানিয়েছিলেন, সেটা নীরব, শূন্য

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

মায়ের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

মা আমার শহরমুখী হতে চাইতেন না। স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা উঠলেই দুশ্চিন্তায় পড়তেন। ঢাকা-যাত্রায় তাঁর অনীহা ছিল সবচেয়ে বেশি।

এটা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগের যুগের গল্প। কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে আরিচা হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগত। একবার মাকে অভয় দিলাম, বাসে মাত্র চার ঘণ্টার পথ!

স্বস্তিদায়ক যাত্রার জন্য শুক্রবার সকাল সাতটার বাস নিই। এক সারিতে মায়ের জন্য দুটি, আমার আর ভাতিজার জন্য আরও দুটি আসন। রাস্তা ফাঁকা, দ্রুত ছুটে চলে গাড়ি। মায়ের আসনে ব্যাগ-কাপড়ের কুশন করে দিয়েছি। জার্নিতে মার অস্বস্তি শুরু হওয়ার আগেই আরিচা ঘাটে পৌঁছে বাস।

তখন ফেরিঘাটেই ছিল মূল ভোগান্তি। ভোগান্তির কারণ দীর্ঘ অপেক্ষা। আজ দেখি ফেরি অপেক্ষমাণ, আর একটি মাত্র বাস উঠলেই ছাড়বে। মাকে বহনকারী বাসটি উঠতেই ফেরি ছাড়ে। ঢাকার পথে বাসের গতি বাড়ে, মা আসনে তন্দ্রাচ্ছন্ন। দুই ঘণ্টার কম সময়ে ঢাকা পৌঁছে যায় বাস। বাসস্ট্যান্ডে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল প্রাইভেট কার। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে একটানে বাসায় এসে পড়ে। ঝিমুনি থেকে উঠে মা জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কোথায়?’

বাসায় চলে এসেছি, নামো।

বললেন, ‘এত ঝক্করে (তাড়াতাড়ি) ঢাকা, ঢাকায় আসায় তো কষ্টই নাই।’

আরও পড়ুন

বাসায় মহা আয়োজন। বহু প্রতীক্ষার পর ‘দুর্লভ অতিথি’কে পাওয়া গেছে। যার আত্মত্যাগে আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সামান্য হলেও তাকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ভোজে অবশ্য মায়ের আগ্রহ নেই খুব। ভরজীবন যিনি কষ্টে কাটিয়েছেন, খাবারের প্রাচুর্য তার কাছে বাহুল্য।

ঢাকায় মার প্রথম কাজ মহাখালীর বিকাশ অফিস। সকালে মাকে নিয়ে গিয়ে দেখি লবিতে বিপুল ভিড়। সেবাপ্রার্থীদের দরজাতেই আটকে রাখা হয়েছে। মাকে ভিড় সামলে ভেতরে যেতে হলে শেষ! কিন্তু লিফট থেকে নামতেই ইউনিফর্মধারী পিয়ন মাকে এসকর্ট করে গার্ডকে বলে, ‘সরো, মুরব্বি ভিতরে যাবেন।’

অন্যদের আটকে রাখার বিপরীতে আমাদের ভিআইপি মর্যাদায় অফিসে ঢুকিয়ে ঝটপট কাজ করে দেওয়া মিরাকল বটে! পেশাসূত্রে জীবনে অগ্রাধিকার পেয়েছি এন্তার, মায়ের সম্মানে অগ্রাধিকার পেয়ে ভিন্ন অনুভূতি হয়।

মা নদীবিধৌত গাঁয়ের মানুষ। ইলিশ, তিনকাটা (বাতাসি), বাঁশপাতা (কাজলি), পাবদা, চিংড়ি এসব নদীর মাছ আসত তাঁদের হেঁশেলে। বৈবাহিক সূত্রে বিল-ঝিলওয়ালা গ্রামে জীবন কাটানোয় কই, পুঁটি, ট্যাংরা, টাকি মাছও রেঁধেছেন মা। নদী-বিলের ছোট মাছের তালিকা করে মাকে খাওয়ানোর পরিকল্পনা করি। আশঙ্কা, ছোট মাছ মিলবে কি না! ঢাকার বাজারে যেসব মাছ দুর্লভ, সেদিন দেখি তা-ও মিলছে বেশ।

মা নাতবউয়ের মুখ দেখবেন। নতুন বউয়ের প্রথম দর্শনে উপহার দেওয়ার চল। দিনের দিন উপহার কিনব ভেবেছিলাম। বাইরের ব্যস্ততার মধ্যে একদিন ফোন এল, মায়ের সঙ্গে নাতবউয়ের দেখা হচ্ছে রাতেই। ছোট্ট হলেও গয়না দেওয়া মায়ের ইচ্ছা। সন্ধ্যায় সোনার মার্কেটে গিয়ে দেখি দোকানপাট বন্ধ। সংবিৎ হয় আজ পয়লা মে, মার্কেট বন্ধ। হাল ছেড়ে রাতে ফিরছি। আশ্চর্য, পথিমধ্যের জুয়েলার্স শোরুমটি খোলা। আলোঝলমল। কোনো খরিদ্দার নেই, তবু সেলসম্যানরা প্রাণবন্ত, অপেক্ষমাণ। একটা আংটির জন্য অসংখ্য বক্স মেলে রকমারি আংটি দেখালেন। অতীতে দেখেছি, বড় দোকানে ছোট গয়না দেখাতে সেলসম্যানরা অনুৎসাহী থাকে। এদের কী হলো?

বাসায় ফিরে দৃষ্টিনন্দন একটি আংটি যখন মায়ের হাতে দিলাম, তখন তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি জানতাম বাবা, যত রাতই হোক, এটা আনবাই।’

মিষ্টির মধ্যে রসগোল্লা তাঁর প্রিয়। ঢাকায় রসে ডোবানো রসগোল্লা কম। কচুক্ষেতের ভাগ্যকুলে গেলাম। সেলসম্যান বলল, স্যারের ভাগ্য ভালো। রসগোল্লা আজ এক কেজি পেতে পারেন।

বাসায় এলে জলি বলল, রসগোল্লাটা মার জন্যই ফ্রিজে থাক। উনি একাই খাবেন।

ফেরার দিন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আবহাওয়া ভালোই ছিল। যাত্রীতালিকায় আমি নেই, মা আর ভাতিজা যাচ্ছে। আসন পূর্ববৎ। মা যখন ঢাকা ছাড়ছেন, তখন আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি। ঢাকা প্রাণ উজাড় করে কাঁদছে। বৃষ্টির মধ্যেই ক্রমে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল মায়ের বাস!

বাসায় ফিরে দেখি, যে ঘরটি মা সাময়িক ইবাদতখানা বানিয়েছিলেন, সেটা নীরব, শূন্য। উঁকি দিলেই যেখানে দেখা যেত সফেদ শাড়িতে ঘোমটাঢাকা মুখ। দুহাতে অজিফার বই। মাথাটি ঈষৎ দুলছে অজিফা পড়ার সঙ্গে তাল রেখে। ঘরময় অপূর্ব শ্রুতিমধুর স্বর্গীয় সুর। আজ শূন্যতা জেঁকে আছে সে ঘরে। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের চোখের বৃষ্টি আর থামছে না।