‘আমার নাম এবং বাংলাদেশের নাম যখন বলা হলো, সত্যিই খুব অবাক হয়েছি’
বিশেষভাবে সক্ষম তরুণদের নিয়ে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল আইটি চ্যালেঞ্জ ফর ইয়ং উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (জিআইটিসি) ২০২২-এ প্রথমবার অংশ নিয়েই বাজিমাত করেছিলেন মো. মিজানুর রহমান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্মের এই শিক্ষার্থী কেমন করে নিজেকে তৈরি করেছিলেন?
ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ডান চোখে একবার প্রচণ্ড আঘাত পান মিজানুর রহমান। অস্ত্রোপচারও করা হয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। আজীবনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন মিজান। এসব ঘটনা যখন ঘটছে, তখন তিনি মাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
মিজানুরের কম্পিউটারপ্রীতি অবশ্য তারও অনেক আগে থেকে। কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় ফুফাতো ভাইয়ের কম্পিউটারে গেমস খেলতেন, নতুন জিনিস শেখার চেষ্টা করতেন। আবার বাজারে এক চাচার ছিল কম্পিউটারের দোকান। সেখানে মূলত কম্পিউটারের কাজ শেখানো হতো। নিয়মিত সেখানে গিয়ে বসে থাকতেন মিজান। দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করতেন। আর এ কাজে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করত তাঁর তুখোড় স্মৃতিশক্তি। একবার কোনো কিছু দেখলেই হুবহু মনে রাখতে পারতেন। এভাবে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ছাড়াই কম্পিউটারের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশির ভাগ কাজ নিজে নিজে শিখেছেন তিনি।
পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর মিজানুরের নিজের একটি কম্পিউটার হলো। তার আগেই অবশ্য অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলেন তিনি। এবার পুরোনো পাঠই ঝালাই করতে শুরু করলেন। শিখন তালিকায় (টু-ডু লিস্টে) যুক্ত করলেন নতুন নানা কিছু।
এসবই অবশ্য অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ভর্তি হয়ে যান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি)। সেখানে এমপাওয়ারমেন্ট অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ইনক্লুডিং এনডিডি থ্রু আইসিটি প্রকল্পের অধীন বেসিক কম্পিউটার অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজেসে প্রশিক্ষণ নেন। এর দু-তিন মাস পর বিসিসি থেকে ন্যাশনাল আইটি চ্যালেঞ্জ ইয়ুথ উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (এনআইটিসি) প্রতিযোগিতা বিষয়ে মিজানুরকে জানানো হয়। মিজানুর তাতে সাড়া দেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন।
জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় যাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন, তাঁরাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্লোবাল আইটি চ্যালেঞ্জ ফর ইয়ুথ উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজে (জিআইটিসি) অংশ নিতে পারেন। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনামসহ মোট ১৬টি দেশ থেকে প্রতিযোগীরা অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মিজানুরসহ ১৭ জন। সবাইকে ছাড়িয়ে শেষ হাসি হেসেছেন মিজানুর। গ্লোবাল আইটি চ্যালেঞ্জের ই-লাইফম্যাপ বিভাগে ভিজ্যুয়াল সেক্টরে প্রথম এবং ই-টুল পাওয়ার পয়েন্ট বিভাগে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি।
গ্লোবাল আইটি চ্যালেঞ্জের আয়োজক দেশ ছিল চীন। হঠাৎ করোনা প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় স্থগিত হয়ে যায় সে আয়োজন। বিকল্প উপায় হিসেবে তখন জুম অ্যাপের শরণাপন্ন হন আয়োজকেরা। সে ক্ষেত্রে এ প্রতিযোগিতায় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ‘গ্লোবাল টক টক’। এর মাধ্যমে প্রতিযোগীরা নিজ দেশে থেকেই অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা, আড্ডা দেওয়ার সুযোগটা পান। সেদিনের স্মৃতিচারণা করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা অনেক মজার ছিল। কারণ, ১৬টি দেশের অনেক প্রতিযোগীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি।’
প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন মিজানুর। এতেই চ্যাম্পিয়ন। বলছিলেন, ‘যখন পুরস্কার ঘোষণা পর্ব শুরু হয়, তখন খুব রোমাঞ্চ কাজ করছিল। টেনশন হচ্ছিল। আমার নাম এবং বাংলাদেশের নাম যখন বলা হলো, সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। আবেগতাড়িত হয়েছি। আমাদের প্রশিক্ষক শোয়াইব স্যার আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম রাব্বানী স্যার, সিএসআইডির ইফতেখার স্যারসহ সবাই আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।’ এ অর্জনকে কাজে লাগিয়ে আরও বহু দূর পথ পাড়ি দিতে চান মিজানুর রহমান।