ট্রেনে জন্ম নেওয়া সাগরিকার বয়স হলো এক, জীবনসংগ্রামে নাজেহাল তার মা

কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহীতে আসছিলেন সন্তানসম্ভবা সাবিনা ইয়াসমিন। চলন্ত ট্রেনেই ওঠে প্রসববেদনা। মেয়েসন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তিনি পাশে পেয়েছিলেন সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেসের যাত্রীদের। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সাবিনার মেয়ের নাম রাখে ‘সাগরিকা’। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর সাগরিকার বয়স এক বছর পূর্ণ হলো।

চলন্ত ট্রেনে ভূমিষ্ঠ সাগরিকার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পর মা সাবিনা ইয়াসমিনের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। জীবনসংগ্রামের অন্য রকম এক গল্পই শুনলাম তাঁর মুখে। সাগরিকার জন্মের তিন মাসের মাথায় স্বামী জাহাঙ্গীর আলম তাঁকে তালাক দেন। এর পর থেকে দুই সন্তান ও ছোট দুই বোনকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে সাবিনা চাকরি নেন চৌকিদারের।

চলন্ত ট্রেনে ভূমিষ্ঠ সাগরিকাকে নিয়ে হাসপাতালে মা সাবিনা ইয়াসমিন
ছবি: প্রথম আলো

সাবিনাদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কামালপুর গ্রামে। ছোট্ট বাড়িটি গোছানো পরিপাটি। বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী চন্দনা। শুধু বর্ষায় পানি থাকে। নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো পার হয়ে সাবিনাদের বাড়িতে পৌঁছাই আজ শনিবার। বাড়িতে পরিবারের কজন সদস্য সাগরিকার প্রথম জন্মদিনের কেক কাটছেন। আমরা একটা কেক নিয়ে গিয়েছিলাম সাগরিকার জন্য। সেটাও কাটা হলো। সাবিনা জানালেন, তাঁর মা-বাবা আগেই মারা গেছেন। এক হাতে সংসারের সবকিছু করেন। ইউনিয়ন পরিষদে দায়িত্ব পালন করেন সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত। এ সময়ে তাঁর মেয়েকে দেখাশোনা করে ছোট বোন শারমিন আক্তার।

আরও পড়ুন
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর সাগরিকার বয়স এক বছর পূর্ণ হলো
ছবি: প্রথম আলো

সন্তান নিয়ে মনোমালিন্য

সাবিনা ইয়াসমিনের সাবেক স্বামী জাহাঙ্গীর আলম সন্তান নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তাই সাগরিকা যখন পেটে আসে, গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। সাবিনা ইয়াসমিন স্বামীর সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁদের মনোমালিন্য শুরু হয়। দিনে দিনে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ে।

গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর সাবিনার ব্যথা শুরু হয়। রাজশাহীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছিলেন, সাবিনা ইয়াসমিনের সন্তান প্রসবজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে। ভালো হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের কারণে তাঁকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে গেলে সেখানে ইনজেকশন দেওয়া হয়। এতেও ব্যথা কমে না। তারপর সাবিনা তাঁর ছোট চাচি জুলেখা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীগামী ট্রেনে উঠে পড়েন। ট্রেনের টিকিট ছিল না। সাবিনা ইয়াসমিন দরজার কাছে মেঝেতে শুয়ে রাজশাহী আসছিলেন। ট্রেনের ভেতরেই তাঁর প্রসববেদনা ওঠে। কাকতালীয়ভাবে ওই ট্রেনেই ছিলেন একজন নারী চিকিৎসক ও একজন আইনজীবী। তাঁদের সহায়তায় রেলের কর্মীরা ট্রেনের ভেতরেই তাঁর সন্তান প্রসবের সব ব্যবস্থা করেন। ট্রেনটি রাজশাহী রেলস্টেশনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে মা-নবজাতককে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

হাসপাতালে কয়েক দিন ছিলেন সাবিনা। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম মেয়েকে দেখতে হাসপাতালে আসেননি। সন্তান নিয়ে বাসায় ফেরার তিন মাসের মাথায় সাবিনাকে তালাক দেন তিনি।

জন্মদিনে মায়ের কোলে সাগরিকা
ছবি: প্রথম আলো

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি মেলেনি

দুই সন্তান ও দুই বোনকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন সাবিনা ইয়াসমিন। এ সময় তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন পিয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা। তিনি সাবিনা ইয়াসমিনকে তাঁর ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার নিযুক্ত করেন। এ কাজ করেই সাবিনা ইয়াসমিন সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বললেন, চেয়ারম্যান সোহেল রানাই তাঁর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর সহযোগিতায় পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন।

সাবিনা ইয়াসমিনের ছোট চাচি জুলেখা খাতুন পাশেই ছিলেন। তিনি জানান, ট্রেনে সন্তান হওয়ার পর রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলেছিলেন, শিশুটি বড় হয়ে বিনা টিকিটে রেলে ভ্রমণের সুযোগ পাবে। কিন্তু এখন ফোন করা হলে তাঁরা ফোন কেটে দেন। শিশুটির জন্ম যে চলন্ত ট্রেনে হয়েছে, এ বিষয়ে একটি সনদপত্র পর্যন্ত দেননি।

সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘মেয়ের নাম রেখেছি সিদরাতুল মুনতাহা। সেই সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া সাগরিকা নামটিও ডাকনাম হিসেবে জন্মনিবন্ধনপত্রে লিখেছি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি একটা সনদ দিত, তবু স্মৃতি হিসেবে সেটি রাখতে পারতাম।’

এ বিষয়ে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, রেলগাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেই বিনা টিকিটে ভ্রমণের পাস দেওয়ার সুযোগ নেই। তখন যে কর্মকর্তারা এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা আবেগের বশবর্তী হয়েই বলেছিলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাঁদের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিধান নেই। এখন এ সুযোগ দিতে হলে জাতীয় সংসদে নতুন করে আইন তৈরি করতে হবে।

ফেরার সময় সাবিনা ইয়াসমিন মেয়েকে নিয়ে চন্দনা নদীর সাঁকো পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। আবার বললেন, ‘দেখেন, যদি লেখালেখি করে রেল কর্তৃপক্ষের সনদটা পাওয়া যায়।’