দেশকে ৫৫ হাজার কৃষিবিদ দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে আজ উৎসবের দিন। আজ তাদের অষ্টম সমাবর্তন। সবকিছু ঠিক থাকলে ৬ হাজার ৫২২ জন স্নাতকের আজ সমাবর্তন হবে। এর মধ্যে স্নাতক পর্যায়ে ১৮ জন ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২০৪ জন পাবেন স্বর্ণপদক। স্নাতক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় আরও ৪৯ জন পাবেন সম্মাননা। এ উপলক্ষে বাকৃবি নিয়ে জানা যাক কিছু তথ্য।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে (বাকৃবি) বলা হয় দেশের কৃষিবিদ তৈরির আঁতুড়ঘর। ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কৃষিশিক্ষা, মৌলিক ও ফলিত গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই বিদ্যাপীঠ। দেশে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন জাত তৈরিতে যে কৃষিবিজ্ঞানীরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৬৪৮ জন কৃষিবিদ তৈরি করেছে। বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের আওতায় বর্তমানে প্রায় ৬০০ গবেষণা কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৩৭টি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩৩টি যৌথ গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
বন্যা, খরা, লবণাক্ত ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্য ও ফলের জাত উদ্ভাবন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। সাড়ে ১১ হাজার ফল ও মসলার প্রজাতি নিয়ে এখানকার ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এ সেন্টার থেকে শতাধিক নতুন ফলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। রয়েছে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ছয় শতাধিক উদ্ভিদের প্রজাতিসমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন। দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর এবং প্রজাতি সংগ্রহ ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় মৎস্য জাদুঘরটিও এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে।
বাকৃবির কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা
গবেষকদের একটি দল সম্প্রতি মাছ থেকে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়াজাত পণ্য উদ্ভাবন করেছে। যেমন মাছের চানাচুর, তিলের খাজা ও আচার, ফিশ পিনাট বার, ফিশ বার্গার, ফিশ চিপস, ফিশ কাটলেট ও ফিশ পাস্তা।
শর্ষের উচ্চফলনশীল ৫টি জাত ও মিষ্টি আলুর নতুন ৩টি জাত উদ্ভাবিত হয় কয়েক মাস আগে।
বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় ধানের জাত ব্রি ধান-২৮ ব্যাপকভাবে পাতা ঝলসে যাওয়া বা ব্লাস্টরোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের আক্রমণে শেষ পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারেন না কৃষক। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্লাস্টপ্রতিরোধী বাউধান-৩ নামে একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন বাকৃবির গবেষকেরা।
পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ হয় বাংলাদেশে। একক প্রজাতি হিসেবে দেশে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ। ইলিশ নিয়ে অধিকতর গবেষণা ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ইলিশের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
দেশি জাতের মধ্যে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগল বাংলাদেশে বেশি পরিচিত। মাংস বেশ সুস্বাদু হওয়ায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল ‘গরিবের গাভি’ নামে পরিচিত। দ্রুত প্রজননশীল, উন্নত মানের চামড়া ও প্রতি প্রসবে একাধিক বাচ্চা দেওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী এ জাতটির জনপ্রিয়তা রয়েছে। এখানে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবনরহস্যও উন্মোচন করা হয়েছে।
‘প্লানটেইন’ নামক একধরনের ঘাসে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এই প্রক্রিয়ায় গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ ও অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ মুরগির মাংস উৎপাদন প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাউ-প্লানটিভ’।
গবাদিপশুর ব্যাকটেরিয়াজনিত একধরনের সংক্রামক রোগ ব্রুসেলোসিস। প্রাণী ও মানবদেহে ছোঁয়াচে রোগগুলোর মধ্যে সংক্রমণের দিক থেকে যক্ষ্মা ও অ্যানথ্রাক্সের পরই ব্রুসেলোসিসের অবস্থান। এ রোগ নির্ণয় করা গেলেও দেশে এ রোগের জন্য ঠিক কোন জীবাণু দায়ী, আগে তা শনাক্ত করা যায়নি। ব্রুসেলোসিস রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ ও এই ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্স এখানে সম্পন্ন হয়েছে।
ইলিশ ও সিলভার কার্প মাছের স্যুপ ও নুডলস তৈরির প্রযুক্তি, শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের প্রযুক্তি, হিমায়িত ভ্রূণ থেকে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন, ভাগনা মাছের জাত উন্নয়ন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সিরোটাইপ নির্ণয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বাকৃবি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ধান শুকাতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয় কৃষকদের। বাকৃবির উদ্ভাবিত ‘বাউ-এসটিআর’ নামক যন্ত্র দিয়ে কম সময়ে, স্বল্প সময়ে ধান শুকানো সম্ভব। এ ছাড়া সার ও বীজ ছিটানো যন্ত্র, পাম অয়েল মেশিন, আগাছা দমন যন্ত্রও উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এখানে বিভিন্ন সময়ে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ প্রযুক্তি, কচি গমের পাউডার উৎপাদন, বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। তারাবাইম, গুচিবাইম, বড় বাইম, কুঁচিয়া, গাঙ মাগুর, কই ও বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজননপদ্ধতিও আবিষ্কার করা হয়েছে।
কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব সার উৎপাদনের প্রযুক্তি, মাটি পরীক্ষার সরঞ্জাম, গবাদিপশুর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন, গাভির ওলান প্রদাহ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহারের প্রযুক্তি—এসবও উদ্ভাবন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।