ইকবাল মতিনের সংগ্রহে ১০০ বছরের বেশি পুরোনো রেকর্ডই আছে দুই হাজার
রাজশাহী নগরের সাগরপাড়া মহল্লায় নিজের বাড়িতে প্রায় আট হাজার গ্রামোফোন রেকর্ড নিয়ে বিশাল এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন ইকবাল মতিন। এর মধ্যে ১০০ বছরের বেশি পুরোনো রেকর্ডই আছে দুই হাজারের বেশি। উপমহাদেশের প্রথম রেকর্ডটিও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। আছে নয়টি সচল গ্রামোফোন যন্ত্র। সংগ্রহশালাটি দেখতে গিয়েছিলেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
২৮ অক্টোবর ২০১৪। রজনীকান্ত সেনের নাতি দিলীপকুমার রায়ের বয়স তখন ৯৮ বছর। তিনি এসেছেন রাজশাহীতে। বসেছেন গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রাহক ইকবাল মতিনের বাসায়। তাঁকে কিছু না বলেই কলের গানে সেনোলা কোম্পানির একটি গ্রামোফোন রেকর্ড চালিয়ে দিলেন ইকবাল মতিন। প্রথম কলি শুনেই দিলীপকুমারের চোখ কপালে। তিনি শুনছেন ১৯৩৭ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড করা গান ‘ওপারে প্রভাত হলো’। লেখা ও সুর সুপ্রীতি সেন। দিলীপকুমার রায়কে অবাক করে দিতেই কাজটা করেছিলেন ইকবাল মতিন।
সবাইকে অবাক করে দেওয়ার মতো এ রকম প্রায় ৮ হাজার ৭৮ আরপিএম গ্রামোফোন রেকর্ড রয়েছে ইকবাল মতিনের কাছে। এর মধ্যে ১০০ বছরের বেশি পুরোনো রেকর্ডই আছে ২ হাজারের বেশি। উপমহাদেশের প্রথম রেকর্ডটিও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। আছে নয়টি সচল গ্রামোফোন যন্ত্র, যেগুলো ১৯১০ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে তৈরি। চাবি দিলেই বেজে ওঠে শত বছরের পুরোনো সুর। গানের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। এই জন্য শুধু সংগ্রহই নয়, তিনি দুর্লভ রেকর্ডগুলোর পেছনের চমকপ্রদ ইতিহাসও জানেন।
যেভাবে শুরু
শিশু বয়স থেকেই তিনি বেহালা বাজাতেন। প্রখ্যাত শিল্পীদের জীবনী নিয়ে পড়াশোনা করতেন। তখন থেকেই ভাবতেন, এই প্রথিতযশা শিল্পীদের গানবাজনা যদি নিজের কানে শোনা যেত! এই নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহে নেমে পড়েন। উপমহাদেশের বিভিন্ন শৌখিন জমিদার, পুরোনো রেকর্ডের দোকান ও সংগ্রাহকদের কাছে ছুটে যান। এভাবেই তিলে তিলে গড়ে তোলেন তাঁর এই সংগ্রহশালা।
ইকবাল মতিন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। শৌখিন সংগীতশিল্পী, সমালোচক, গবেষক ও জনপ্রিয় বেহালাবাদক। দেশে-বিদেশে বেহালা বাজিয়ে তিনি অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন। রাজশাহী নগরের সাগরপাড়া মহল্লায় তাঁর বাড়ি। জন্ম ১৯৫৬ সালে। বাসার দোতলার চারটি কক্ষে তিনি জিনিসগুলো এমনভাবে সাজিয়েছেন যে তা হয়ে উঠেছে গ্রামোফোন রেকর্ডের জাদুঘর। সেখানে বসেই তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হলো।
কত সুর কত কথা
ভারতবর্ষের গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রথম গান থেকে শুরু করে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত ৭৮টি রেকর্ড কোম্পানির বহু দুর্লভ রেকর্ডের মালিক ইকবাল মতিন। এগুলো সাধারণত ১০ ইঞ্চি ব্যাসের হতো। সেগুলো ছাড়াও তাঁর কাছে বেশ কিছু ১৬, ১২, ১১, ৯, ৮, ৭, ৪ ও ৩ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড রয়েছে। এ ছাড়া অত্যন্ত দুর্লভ পিচবোর্ড, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি রেকর্ডও আছে।
সেই সময় কোনো গানবাজনা ধারণ করার পর তার একটি মাস্টার কপি বা স্যাম্পল কপি সেই শিল্পীর কাছে পাঠানো হতো। তিনি সেটা অনুমোদন করলেই তা বাজারে ছাড়া হতো। সেই সময়ের এমন ১১৯টি মাস্টার কপি তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। পাজল প্লেট খুবই দুর্লভ। এই প্লেটে পরপর তিনবার পিন রেখে ঘোরালে তিন রকম গান বাজে। সেটির তিনখানা তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর গুরু তানসেনের বংশধর উজির খাঁর রেকর্ড, ১৯০৯ সালে ধারণকৃত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের স্বকণ্ঠে গাওয়া গানের রেকর্ড, রাজা পঞ্চম জর্জ, রানি মেরি, লর্ড মাউন্টব্যাটেন, অষ্টম এডওয়ার্ড, সরোজিনী নাইডু, মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বসুর ভাষণও রয়েছে। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জমিদারবাড়িতে ঘুরে, গবেষণার কাজে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দিনের পর দিন লেগে থেকে এসব সংগ্রহ করেছেন।
‘আই অ্যাম মিস গওহরজান’
ভারতবর্ষে গ্রামোফোনের প্রথম রেকর্ডিং হয় ১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর। তাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন দুই নৃত্যশিল্পী শশীমুখী ও ফণীবালা। সেই রেকর্ড তো আছেই। তার সঙ্গে ওই বছরেই আরও যাঁদের গান রেকর্ড করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে গওহরজান, শৈলাবাই, বিনোদিনী, হরিমতি, রানি, ভুবনেশ্বরী, ছোটারানি, কিরণ ও পান্নালাল সরকারের বেশ কয়েকটি রেকর্ডও তাঁর সংগ্রহে আছে।
১৯০৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় গানবাজনা ধারণ করে জার্মানির হ্যানোভার শহরে রেকর্ডের কপি করাতে হতো। কপি করানোর সময় শিল্পীর নাম যাতে ভুল না হয়, সেই জন্য শিল্পীরা গানের শেষে চিৎকার করে নিজের নাম বলতেন, যেমন ‘আই অ্যাম মিস গওহরজান’। গওহরজানের এমন রেকর্ডও শোনালেন তিনি। পাশাপাশি অন্য শিল্পীদেরও সেই রকম রেকর্ড শোনা হলো, যাতে শিল্পীরা চিৎকার করে নিজের নাম বলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সংগতকারী তবলাবাদক ও হারমোনিয়ামবাদকের নাম উচ্চারণ করেছেন, এমন রেকর্ডও দেখা হলো।
‘ভুলে গেলে বলে বলে দিয়ো’
সংগ্রহের রেকর্ডগুলোর পেছনের গল্পও চমকপ্রদ। ১৯০২ সালে লালচাঁদ বড়াল গ্রামোফোনে ধ্রুপদি সংগীতের প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। লালচাঁদের বাবা ছিলেন অ্যাটর্নি। গানবাজনা পছন্দ করতেন না। তাই বাবাকে গোপন করেই গানের চর্চা করতেন। মা জানতেন। লালচাঁদ মায়ের উদ্দেশে গেয়েছিলেন, ‘ও মা কেমন মা কে জানে’ এবং ‘তুমি কাদের কুলের বউ গো তুমি’। এ গান শুনে তাঁর বাবা তাঁকে গান করার অনুমতি দেন। দুটি রেকর্ডই আছে ইকবাল মতিনের কাছে।
শোনালেন আরও মজার কথা। ১৯০৪ সালে ‘তোমার ভালো তোমাতে থাক’ গানটি রেকর্ড করার সময় গানের কথা ভুলে যাওয়ার আশঙ্কায় লালচাঁদ বড়াল রেকর্ডিংয়ের সময় যন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘ভুলে গেলে বলে বলে দিয়ো’। গানের ফাঁকে এ কথাও রেকর্ড হয়ে গেছে। এই ধরনের রেকর্ডও রয়েছে তাঁর কাছে। ইকবাল মতিন বলে যান, লালচাঁদ খুব অল্প দিন বেঁচেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৭০ সালে। বেঁচেছিলেন ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। যখন তাঁর মৃতদেহ গাড়ি করে বাড়ি থেকে বের করা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় গ্রামোফোন কোম্পানি একইভাবে গাড়িতে করে তাঁর বাড়িতে উপহারসামগ্রী নিয়ে ঢুকছিল। এই লালচাঁদ বড়ালের গুরু নিকুঞ্জবিহারী দত্তের রেকর্ডও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে।
বটতলায় আমন্ত্রণ
শিল্পী অঘোরনাথ চক্রবর্তীর জন্ম ১৮৫২ সালে। বেঁচেছিলেন ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। গ্রামোফোনে রেকর্ড করার ব্যাপারে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিছুতেই রেকর্ড করাবেন না। কোম্পানির লোকেরা শেষ পর্যন্ত তাঁর এলাকার জমিদারের শরণাপন্ন হন। জমিদারের পরামর্শমতো রেকর্ড কোম্পানির লোকেরা তাঁর বাসায় শিল্পীর অগোচরে আড়াল থেকে গান রেকর্ড করেন। শুধু হারমোনিয়াম ও তবলা দিয়েই তাঁর চারটি গান রেকর্ড করা হয়। বাজিয়ে শোনা হলো সংগ্রহে থাকা সেই চারটি গানের একটি।
সরোদে প্রথম রেকর্ডিং হয়েছিল ১৯০৫ সালে। প্রথম রেকর্ডটি ছিল চুন্নু খাঁর। তিনি বটতলায় বসে সরোদ বাজাতেন। কেউ শুনতে চাইলে তাঁকে আগে দুই আনা সেলামি দিতে হতো। একবার জমিদার তাঁর সরোদ শোনার জন্য বাড়ি থেকে লোক পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু চুন্নু খাঁ জমিদারকেই বটতলায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নিজে জমিদারবাড়িতে যাননি। গ্রামোফোনে সরোদের প্রথম রেকর্ডটিও ইকবাল মতিন জোগাড় করেছেন।
ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিসের মা জদ্দন বাই ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নারী সংগীত পরিচালক। শোনা হলো জদ্দন বাইয়ের কণ্ঠে উচ্চাঙ্গসংগীত। এ ছাড়া লতা মঙ্গেশকরের বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের গাওয়া উচ্চাঙ্গসংগীতও শোনা হলো।
কমলা যেভাবে ঝরিয়া হলেন
শিল্পী কমলা ঝরিয়ার নামের উপাধি কীভাবে ‘ঝরিয়া’ হলো, তা হয়তো অনেকেই জানেন। আসলে তাঁর নাম কমলা সিনহা। তাঁর গান রেকর্ড করার পর কোম্পানির লোকেরা খেয়াল করেন কমলার পদবি জানা হয়নি। তখন কাজী নজরুল ইসলাম জানতে চান, মেয়েটিকে কোন জায়গা থেকে আনা হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মেয়েটিকে প্রখ্যাত শিল্পী কে মল্লিক বিহারের ঝরিয়া এলাকা থেকে এনেছিলেন। নজরুল ইসলাম বললেন, রেকর্ডে ওর নাম কমলা ঝরিয়া লিখে দাও। কমলা ঝরিয়ার অনেক রেকর্ডই ইকবাল মতিনের সংগ্রহে রয়েছে।
সেতারে প্রথম রেকর্ডটি ছিল এমদাদ খাঁর (১৮৪৮-১৯২০)। তাঁর ছেলে এনায়েত খাঁ ছিলেন ভারতবিখ্যাত সেতারশিল্পী বিলায়েত খাঁয়ের বাবা। এমদাদ খাঁর এই প্রথম রেকর্ডটিসহ তাঁর এবং এনায়েত খাঁর বেশ কয়েকটি রেকর্ড তাঁর সংগ্রহে আছে।
ওস্তাদ বদল খাঁর ১০০ বছর বয়সে বাজানো সারেঙ্গির রেকর্ডও আছে তাঁর কাছে।
রবিবাবুর গান
১৯২৫ সাল পর্যন্ত রেকর্ডে কোনো গীতিকারের নাম লেখা থাকত না। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষের মুখে প্রচলিত ছিল ‘রবিবাবুর গান’ বলেই। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে পর্যন্ত রবিবাবুর গানের ১৩৩টি রেকর্ড তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। আছে এডিসন রেকর্ড কোম্পানি থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রকাশিত ৯৯টি রেকর্ড ও ডিস্ক রেকর্ডের আবিষ্কারক এমিল বার্লিনারের কোম্পানির ১৮৯৯ ও ১৯০০ সালের ২টি রেকর্ড।
১৯১৬ সালে বাঙালি পল্টনের সৈন্যরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাওয়ার সময় হাওড়া রেলস্টেশনে তাঁদের সম্মানে যে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, গ্রামোফোন কোম্পানি তা সরাসরি রেকর্ড করে। এটিও রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।
১৯৩৭ সালে আমেরিকায় নৃত্যসম্রাট উদয়শঙ্করের নৃত্যের সঙ্গে তাঁর যন্ত্রীদল যে অর্কেস্টা বাজিয়েছিল, তা আরসিএ ভিক্টর কোম্পানি চারটি গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করেছিল। সেগুলোও আছে তাঁর সংগ্রহে।
গান নয়, অন্য কিছু
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, দানীবাবু, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, তিনকড়ি চক্রবতী, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, কুসুমকুমারী, নরীসুন্দরী, রানিসুন্দরী, তারাসুন্দরী, বসন্তকুমারীসহ অনেকের অভিনয়ের অংশবিশেষ গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো রেকর্ড করে। এগুলোর বিরাট সংগ্রহ রয়েছে ইকবাল মতিনের কাছে। শুধু সংলাপই নয়, সেই সময়ের ৬৪টি নাটকের প্রায় আট শতাধিক রেকর্ড তিনি জোগাড় করেছেন।
মজার ব্যাপার, বাটা শু কোম্পানি তিরিশের দশকে এইচএমভি কোম্পানিকে দিয়ে কয়েকটি বিজ্ঞাপন রেকর্ড করিয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনের নয়টি রেকর্ড ও জাদুসম্রাট পিসি সরকারের দুটি জাদু শেখানোর একটি রেকর্ড বের হয়েছিল। সেটি সংগ্রহ করতেও ভোলেননি ইকবাল মতিন।