আমার কাছে বাবা মানে ঈদের সময় খুব যত্ন করে মিথ্যা বলা

১৮ জুন ছিল বাবা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। তবে পরম শ্রদ্ধার পাশাপাশি বাবার প্রতি অনেকের পাহাড়সমান অশ্রদ্ধাও জমে আছে। তেমন একজন বাবাকে নিয়ে লিখেছেন ঊর্মি হক

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

আপনারা বলেছিলেন বাবা দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখতে। দুঃখিত, আপাতত সেটা পারছি না! কোনোকালে পারব বলেও মনে হচ্ছে না। শ্রদ্ধা শব্দটা বাবা শব্দের মতোই অনেককাল আগে মরে গেছে। না, মরে যাওয়া মানে যে মরেই যাওয়া, ঠিক তা না। কোনো কোনো মরে যাওয়া দায় এড়িয়ে বেঁচে যাওয়ার সমান। তিনি সেই দলেরই লোক। শ্রদ্ধা শব্দটা বইয়ের পাতায় যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, বাবা শব্দটাও আমার কাছে ঠিক তেমনই অতীত মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দুই বোনের জন্মটাই কেবল তাকে বাবা করেছিল। আর কিছুর জন্য তাঁকে বাবা হতে হয়নি। পরিবার শব্দটার দায় এড়িয়ে বাবা হয়ে থাকা কত সহজ, দেখে যাচ্ছি তো। এমন বাবাদের কথা লেখার জন্য বলবেন না? বাবা দিবসের নানা আয়োজন এই বাবাদের বাদ দিয়েই করবেন? শুধু শ্রদ্ধাই নিবেদন করতে আহ্বান করলেন। অশ্রদ্ধা লিখব কোথায়?

আমার কাছে প্রাক্‌-শৈশবে বাবা মানে কাঁঠালগাছ থেকে পাতাসহ ভেঙে আনা ডালের আঘাতে মায়ের আর্তচিৎকার। ভয়ে গুটিসুটি হয়ে দৃশ্যগুলো হজম করা। তারপর বাবা মানে শৈশবের আশপাশে থাকা মানুষের নানা প্রশ্নের মিথ্যা উত্তর দেওয়া। উত্তরটুকু অবশ্য মায়ের শিখিয়ে দেওয়া ছিল। সুবোধ বালিকার উত্তরগুলো ছিল এ রকম, ‘বাবা ঢাকায় কোম্পানিতে চাকরি করে, ছুটি পায় না তো, তাই আসে না।’ তখন আসলে বুঝতামই না ‘কোম্পানি’ মানে কী। শুধু জানতাম, এটা বলতে হবে, কারণ মায়ের শিখিয়ে দেওয়া!

কৈশোরেও সেই একই প্রশ্নের উত্তর সুখী-সুখী ভাব নিয়ে দিয়ে গেছি। আসলে অন্যের মনে দুঃখবোধ জাগ্রত হলে খুব যে অস্বস্তিতে ভুগতে হয়, তত দিনে সেটা শিখে গিয়েছিলাম হয়তো। আমার কাছে বাবা মানে মায়ের একাকিত্বের দীর্ঘ লড়াই। বাবা মানে মায়ের সেই সেলাই মেশিনটা। এরপর বাবা মানে ছিল বইয়ের বোঝা কাঁধে না চাপিয়ে তাঁর রেখে যাওয়া সংসারের বোঝাটা কাঁধে নেওয়া। নিয়েছিলামও শেষ পর্যন্ত। আমার কাছে বাবা মানে ক্লাস, শিক্ষক, ক্যাম্পাস, বন্ধু, আড্ডাহীন কতগুলো কাগজের সার্টিফিকেট অর্জন। বাবা মানে ঈদে খুব যত্ন করে মিথ্যা বলা, ‘বাবা তো ছুটি পায়নি।’ ছোট বোনের মুখে হাতে গোনা কয়েকবার ‘আব্বু’ নামক শব্দটি শুনতে পাওয়া। কারণ, তাকে এই ‘আব্বু’ নামের লোকটিকে কোনো এককালে পরিচয় করিয়ে চিনিয়ে দিতে হয়েছিল।

এবার আসি বড়বেলায়। বাবার উপস্থিতি ছাড়াই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। তাই আমার মা শাশুড়ি হলেও তিনি শ্বশুর হতে পারেননি। যদিও সেই বিয়ের সম্পর্কটা আর নেই। নেই মানে টিকিয়ে রাখিনি। এটাই হয়তো প্রকৃতির বিচার। পিঁড়িতে পা দিয়েই বুঝেছিলাম, আমি আমার প্রাক্‌-শৈশবের সেই ভয়ংকর সময়কেই আবার বরণ করে নিয়েছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর মায়ের মতো ‘মহীয়সী’ হতে পারলাম না।

আমি এখন ৩৬। এখন আমার কাছে বাবা মানে যেকোনো ঘৃণিত পুরুষ। বাবা মানে মাকে একাকী বৃদ্ধ হতে দেখা। ছোট বোনের বিদেশবিভুঁইয়ে একাকী জীবনযাপন। তবু বেশ তো আছি! ভালোই আছি। তবু কেন ফিরে আসে ছোটবেলার প্রশ্নগুলো? বাবা ছেড়ে গেলেও বাবা শব্দটা কেন ছাড়ে না? প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে গেলে ঠিক চলে আসে। তবে হ্যাঁ, উত্তরের ধরনগুলো বদলিয়েছি এখন। এখন আর পারতপক্ষে মিথ্যা বলি না। মাথা উঁচু করে বলে দিই—তিনি এই পৃথিবীতেই বেঁচে আছেন। স্ত্রী-সন্তানের সব দায় এড়িয়ে দিব্যি বেঁচে আছেন! আরও কারও বাবা হয়ে কি না জানি না।

আমার কাছে বাবা মানে আমার পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি নামমাত্র, যে নামের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই!