শিক্ষকতা আমার স্বপ্ন ছিল, আর ক্রিকেট ছিল নেশা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয়া রানী দাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতক ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও ছিলেন সমান আগ্রহী। তারই ফল পেলেন যেন গত ২৩ মার্চ। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি তাঁকে আন্তর্জাতিক প্যানেলে ম্যাচ রেফারি মনোনীত করেছে। শিক্ষকতা পেশা বজায় রেখে আইসিসির ম্যাচ রেফারি হওয়ার পথটা কেমন ছিল? সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজিদ হোসেন

প্রথম আলো:

খেলাধুলায় আপনার হাতেখড়ি কখন, কীভাবে?

আমি সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ার মেয়ে। বাবা-চাচারা খেলাধুলায় অনেক উৎসাহী ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তাঁদের রেডিওতে খেলা শুনতে দেখেছি। আমার দুই ভাই। আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। স্কুল-কলেজেও খেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর খেলাধুলার সুযোগ আরও বেড়েছে। চারবার রোকেয়া হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও দুবার রানার্সআপ হয়েছিলাম। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল ও ভলিবল দলের অধিনায়কও ছিলাম। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল ও হ্যান্ডবলে আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

প্রথম আলো:

ক্রিকেটার হলেন কীভাবে?

দেশে মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০০৭ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সেবার ভোলা জেলার হয়ে খেলেছিলাম। আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। মূলত এরপরই আবাহনীতে খেলার সুযোগ পাই। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিভাগ, সিলেট বিভাগ, আবাহনী দল, মৌলভীবাজার জেলা ও দীপালি যুব সংঘে খেলেছি।

প্রথম আলো:

আর আম্পায়ার?

২০১১ সালে বিসিবি আয়োজিত আম্পায়ারিং কোয়ালিফাইং পরীক্ষায় আমার ব্যাচে আমি প্রথম হয়ে পাস করি। ২০২২ সালে বাংলাদেশে নারী আম্পায়ারিং শুরু হলে আমার কর্মক্ষেত্র থেকে অনুমোদন নিয়ে তাতে সম্পৃক্ত হই।

প্রথম আলো:

কখনো কি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়েছিল?

২০১১ সালে ট্রাইনেশন কাপের জন্য ঘোষিত জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেবারই স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনায় ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্পে যোগ দিইনি। ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর একরকম বাধ্য হয়েই ক্রিকেট ছেড়ে দিই। শিক্ষকতার পাশাপাশি ফিটনেস ঠিক রেখে ঢাকায় গিয়ে নিয়মিত খেলাধুলা করা আসলে সম্ভব ছিল না।

ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব উপভোগ করেন সুপ্রিয়া
ছবি: সংগৃহীত
প্রথম আলো:

আম্পায়ার হিসেবে এখন পর্যন্ত কয়টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন?

২০২২ সালে মিরপুরে বিজয় দিবসের ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে আমার যাত্রা শুরু। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫টি বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছি।

প্রথম আলো:

ক্রিকেটার থেকে শিক্ষকতা। এরপর আম্পায়ার। তারপর আবার ম্যাচ রেফারি। কোন কাজটি সবচেয়ে উপভোগ্য?

এখন রেফারির কাজটা খুব উপভোগ করছি। শিক্ষকতা ও ম্যাচ রেফারি—এই দুই দায়িত্বের মধ্যে একরকম মিল আছে বলে মনে হয়। দুটি ক্ষেত্রেই প্রচুর পড়াশোনা, সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ও পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্যাপার আছে।

প্রথম আলো:

শিক্ষকতার পাশাপাশি এখন আইসিসির ম্যাচ রেফারি হলেন। কোন কাজটাকে প্রাধান্য দেবেন?

শিক্ষকতা আমার বাস্তব হওয়া স্বপ্ন। প্রথম বর্ষের ফল প্রকাশের দিন থেকেই এই পেশায় আসার স্বপ্ন দেখেছি। আর ক্রিকেট আমার নেশা। শুধু আমিই নই, আমার বাবার বাড়ি, মামার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির সবাই এই নেশায় বুঁদ! তবে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা আমার কাছে প্রাধান্য পাবে। ক্লাসে পড়ানোর সময় ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানপিপাসু চোখ, পিনপতন নীরবতা, পুরো পরিবেশটাই ভীষণ ভালো লাগে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক ছুটির সুযোগ আমার আরেক স্বপ্ন, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারি হিসেবে কাজের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে বলে আশা করছি।

প্রথম আলো:

আপনার পরিবারের কেউ কি ক্রীড়াজগতের সঙ্গে যুক্ত?

বাবা একসময় সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। তবে তিনি খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় পরিবারের মধ্যে আমিই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র। তবে আমার স্বামী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল ও ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। পরিবার সব সময়ই আমার প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে স্বামী, বড় ভাই এবং শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে অসম্ভব সহযোগিতা করেছেন।এখনো করেন। নয়তো পিএইচডির পড়াশোনার পাশাপাশি এ কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারতাম না। আমার গবেষণা-তত্ত্বাবধায়কও নিরন্তর উৎসাহ দেন।

প্রথম আলো:

শিক্ষকতার পাশাপাশি আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব কীভাবে সামলেছেন?

আমি আসলে যখন যে কাজ করেছি, সর্বোচ্চ মনোযোগ আর শ্রম দিয়ে আনন্দের সঙ্গে করতে চেয়েছি। বিশ্বাস করি, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সেটি কমবেশি কাজে লাগে। এমনও হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার ক্লাস নিয়ে বিকেলে ঢাকায় রওনা হয়েছি। অনেক রাতে ঢাকায় পৌঁছে সকাল ছয়টায় বিকেএসপিতে ম্যাচ পরিচালনা করেছি শুক্র-শনিবার। শনিবার রাতের গাড়িতেই আবার রাজশাহীতে রওনা হয়ে পরদিন রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজে যোগ দিয়েছি।

প্রথম আলো:

আপনার মতো যাঁরা পড়াশোনা ও খেলাধুলা—দুটিতেই আগ্রহী, তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?

অনেকে ভাবেন, যারা খেলাধুলা করে, তারা পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় বা পড়াশোনা করতে চায় না। আমি পড়াশোনা করেছি, পাশাপাশি নিজের আনন্দে নিয়মিত খেলাধুলা করেছি। সদিচ্ছা-পরিশ্রম, পরিবার ও শুভানুধ্যায়ীদের সমর্থন এবং নিজের জীবনে শৃঙ্খলা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে প্রায় ২৫ বছর যাবৎ প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় যখন প্রথম শ্রেণি পেয়ে প্রথম হই, পড়াশোনায় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য অনেকেই আমাকে খেলা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সে সময়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র-উপদেষ্টা হোসনে আরা ম্যাম আমাকে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মনকে ভালো ও সজীব রাখার জন্য হলেও তুমি ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারো। আমি জানি, তুমি পারবে।’ সবার সহযোগিতায় আমার খেলাধুলা চলমান ছিল। পড়াশোনা ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সৃষ্টিকর্তা তাকেই সাহায্য করেন, যে নিজেকে সাহায্য করে। আর কোনো শেখাই ব্যর্থ হয় না, এটা আমি বিশ্বাস করি।