মায়েরাই কেন চাকরি ছাড়েন

সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক মা–ই চাকরি ছেড়ে দেন
ছবি: প্রথম আলো

বেশ কিছু কারণে গত এপ্রিলে চাকরি ছেড়েছি। প্রথম তিন মাস যেন চোখের পলকে চলে গেছে। দুটি ঈদ গেল, ছেলের স্কুল, তাকে আনা-নেওয়া, তার সঙ্গে সময় কাটানো, রান্না-ঘরকন্নায় বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল।

তবে ‘বেকার’ জীবনের চার মাসের মাথায় এসে মনে হচ্ছে, হয়তো আবার কাজে ফেরা দরকার। ফেসবুকে অন্য সহকর্মীদের জীবন দেখে মনে হচ্ছে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমি পিছিয়ে পড়ছি। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারি না। কী করব, কী করছি, চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি না, নতুন কোথাও পছন্দমতো কাজ পাব কি না—এসবই ভাবতে থাকি।

দীর্ঘ ১১ বছর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরি করছেন তানিয়া আফরোজ। সাত ও পাঁচ বছর বয়সী দুই সন্তানকে সময় দেওয়ার জন্য সম্প্রতি অব্যাহতি নিয়েছেন। তিনি বলেন, যখন ওরা ছোট ছিল, ওদের প্রয়োজনগুলো ছিল জৈবিক, যেমন খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো। এগুলো যে কেউ করতে পারে। ওদের এখন ইমোশনাল সাপোর্ট লাগে, ওরা আমাকে পাশে চায়।

কিছুদিন আগে তানিয়ার বড় মেয়ে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। প্রতিযোগিতার মান অনুযায়ী, তার মেয়ের বেশ ভালো করার কথা। কিন্তু দেখা গেল, সে ভীষণ খারাপ করেছে।

আরও পড়ুন
মা-মেয়ের আনন্দময় মুহূর্ত
ছবি: প্রথম আলো

তানিয়ার মনে হলো, কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন, সন্তানদের জীবন মা-বাবার আরও সময় চায়। আর তখনই চাকরি ছাড়ার কথা ভাবেন।

‘এখনকার চাকরিগুলো আগের মতো নেই। আপনি ৯টায় ঢুকতে পারবেন, কিন্তু ৫টায় বের হতে পারবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। তারপর রাস্তার নানা ঝক্কি সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত। বাড়ি ফিরেও নানা কাজ। ওদের স্কুলের মিটিং থাকলেও যেতে পারতাম না। সারা দিনের পরিশ্রমের পর নিজেরও বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করে। ফলে ওদের কথা শোনারও সময় হতো না সব সময়।’

ওই প্রতিযোগিতার ফল দেখার পর তানিয়ার মনে হচ্ছিল, কেন এত দৌড়ঝাঁপ করছি? প্রয়োজনে ওদের পাশে থাকতে পারছি না। হ্যাঁ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে, ওদের যা ইচ্ছা কিনে দিতে পারছি। কিন্তু ওরা যদি বড় হয়ে বলে, আমরা তো এসব চাইনি, আমরা তোমাকে চেয়েছি—তখন আমি কী জবাব দেব? তানিয়ার মা এবং শাশুড়ি দুজনেই চাকরি করতেন। তাই মায়ের চাকরি করার সুফলগুলোও জানেন তিনি। তারপরও যে একাকিত্ব ছোটবেলায় তিনি বোধ করেছেন, সেটা যেন তার মেয়েরা অনুভব না করে, সেটা নিশ্চিত করতেই তাঁর এই পদক্ষেপ।

মায়েরা কখনো বেকার নন

ভালো ডে–কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে অনেক মাকেই হয়তো চাকরি ছাড়ার কথা ভাবতে হতো না
ছবি: প্রথম আলো

সন্তানদের সময় দিতে দীর্ঘ ১৫ বছরের পেশা থেকে বিরতি নিয়েছেন শামীমা সুলতানা। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলের সাবেক এই শিক্ষক দুই সন্তানের মা, বড়জনের বয়স ১১ বছর, ছোটজন দেড় বছর বয়সী।

মূলত ছোট সন্তান জন্মের পরই চাকরি থেকে বিরতি নেন। কারণ, এত ছোট শিশুকে গৃহসহকারীর হাতে ছেড়ে দিতে মায়ের মন মানেনি।

শামীমা বলেন, বড় সন্তানের সময় আমার শ্বাশুড়ি ছিলেন। তাঁর কাছে মেয়েকে রেখে যেতে তেমন ভাবতে হতো না। কিন্তু ছোট সন্তান হওয়ার সময় সেই সুযোগ ছিল না।

শিক্ষকতা তাঁর খুব পছন্দের পেশা জানিয়ে বলেন, আমার স্কুল আমাকে দুই বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিয়েছে। কিন্তু ছুটি শেষে আর ফিরতে পারিনি। একদিকে নিজের পরিচয়, আত্মবিশ্বাস, আর্থিক স্বাধীনতা; অন্যদিকে মাতৃত্বের ডাক। কেউ আমাকে জোর করেনি। তবু মায়ের মন বলেছে, এখন সন্তানদের বড় করাই আমার সবচেয়ে বড় কাজ।

ক্লাসরুম, শিক্ষার্থীদের পড়ানো—সবকিছু মনে পড়লেও এখন সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোটা খুব উপভোগ করছেন, জানালেন শামীমা। ‘চাকরি ছেড়ে দিলেও একজন মা কখনোই বেকার নন। তিনি হয়তো আগের মতো রোজ অফিস যান না, কিন্তু তিনি তার সন্তানের মাঝে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার কাজ করছেন। সেটা তো কম নয়!’

আপাতত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি না করলেও শামীমার ইচ্ছা ঘরে বসেই অনলাইনে শিশুশিক্ষার কোনো একটি মাধ্যম খোলা। যেখানে অন্য শিশুদের যেমন শেখাতে পারবেন, নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন; তেমনি বড় করে তুলতে পারবেন তাঁর সন্তানদের, তাদের দিতে পারবেন কোয়ালিটি টাইম।

আরও পড়ুন

তবে কি মেয়েরা চাকরি করবে না?

সন্তান প্রতিপালনে পরিবারের অন্যদেরও সমান ভূমিকা পালন করতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

এই প্রশ্ন করেছিলাম তানিয়া ও শামীমা দুজনেরই কাছে। জানতে চেয়েছিলাম, সন্তানের জন্য যদি চাকরি ছেড়েই দিতে হয় তাহলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে কোথায় যাবে?

তানিয়া বলেন, ছেলেমেয়ে সবার জন্যই লেখাপড়া শেখাটা কেবল চাকরি করার জন্য হওয়া উচিত না। লেখাপড়া শিখতে হবে সুনাগরিক হওয়ার জন্য, রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য, অন্যের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তা ছাড়া লেখাপড়া না জানলে আমি তো আমার সন্তানকেও ঠিকমতো বড় করতে পারব না। শিক্ষিত বলেই তো বুঝতে পেরেছি যে ওদের আমাকে দরকার। ওকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া দরকার, ওকে কীভাবে খাওয়াব, স্ক্রিনটাইম দেব কি না—এসব সিদ্ধান্তই নিতে পেরেছি, কারণ আমি লেখাপড়া জানি।

চাকরি ছাড়তে পেরেছেন বলে নিজেকে প্রিভিলেজড মনে করেন তানিয়া। তিনি বলেন, ‘সবার তো এই সুবিধা থাকবে না। কোনো মেয়েকে বড় হয়ে নিজের বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে হতে পারে, বিয়ের পর কারও বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে, তখন যদি সে চাকরি না করে, তাহলে এসব দায়িত্ব পালন করবে কীভাবে?‘

পুরোপুরি উপার্জন ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে নন শামীমা। তিনি বলেন, সন্তানের বড় হওয়ার একটা সময়ে মাকে প্রয়োজন হয়। যেহেতু সে প্রাইমারি কেয়ারগিভার। সেই সময় চাকরি করতে গেলে মনে হয় তাকে ডিপ্রাইভ করছি। চাইলে এখন বাসায় বসেই কাজ করা যায়। এখন তো অনেক ধরনের ফ্রিল্যান্স করা যায়, উদ্যোক্তা হওয়া যায়।’

মাতৃত্ব যেন তাঁর ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক বলেন, ‘আমাদের দেশে মায়েরা সন্তানের জন্য ক্যারিয়ারে বিরতি নিলে সেটা খুব নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন মায়েরা বিরতি নিয়ে ফেরার পরও সহজে কাজে ঢুকতে পারেন। মাতৃত্ব যেন তাঁর ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সমাজ ও পারিবারিক পরিসরে সবাই মিলে দায়িত্ব নিলেই শুধু এ সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব।’

মায়েরা যখন দেখেন তাঁর সন্তান ডিভাইসনির্ভর হয়ে পড়ছে, তার খেলার জায়গা নেই, বাড়ির বাইরে তার নিরাপত্তা নেই, তার সাংস্কৃতিক বিকাশের কোনো ব্যবস্থা পাড়া বা মহল্লায় নেই, তখন বাধ্য হয়েই তারা চাকরি ছেড়ে সন্তানকে সময় দিতে যান, বলেন রাশেদা রওনক। আর এ সমস্যার সমাধানে, মায়ের পাশাপাশি বাবা, পরিবারের অন্য সদস্য, সমাজ, প্রতিবেশী এবং রাষ্ট্রকেও যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।

আরও পড়ুন