অতিথির পায়ের শব্দ শুনেই কান খাড়া করে ফেলেছিল। উঠানে দেখতে পেয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরটা। তপন লাল রবিদাস এগিয়ে এসে কুকুরটাকে শান্ত করলেন। রাগে গরগর করা কুকুরের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তপন বললেন, ‘এইডার নাম আওশি। খুব রাগী!’
তপন রবিদাসের বাড়িতে এখন পাঁচটি গ্রে হাউন্ড আছে। এর মধ্যে একটি বাচ্চা। বড় চারটির মধ্যে তিনটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড—বাগি, মধু ও আওশি। বাগি অন্তঃসত্ত্বা। পুরুষটির নাম টমি। তারা কোনোটা শিকলে বাঁধা, কোনোটা বাঁশ ও স্টিলের খাঁচায় বন্দী। ভগ্ন চেহারা সবার। পর্যাপ্ত খাবারদাবার যে পেটে পড়ে না, তা কুকুরগুলোর চেহারায় স্পষ্ট। তপন বিষয়টি বুঝতে পেরে আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমরা যা খাই, কুকুরগুলোকেও তা–ই খাওয়াই। নিয়মিত মাংস, ভাত, দুধভাত খাওয়াতে পারলে ওরা অনেক শক্তিশালী হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে আমরা এসব খাবার খাওয়াইতে পারি না।’
তপন লাল রবিদাস পেশায় মুচি। বংশপরম্পরায় তাঁদের পরিবার গ্রে হাউন্ড জাতের কুকুর লালন-পালন করে আসছে। তপন লালের বড় ভাই যতন লাল রবিদাস ও চাচাতো ভাই জিতু লাল রবিদাসও গ্রে হাউন্ড কুকুর লালন-পালন করেন। তবে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিক্রির কাজটি করেন তপন।
জানালেন, প্রতিবছর তপন একাই পাঁচ থেকে ছয়টি কুকুর বিক্রি করেন। এই যেমন ছয় মাস আগে দুই লাখ টাকায় তিন ভাই ছয়টি কুকুর বিক্রি করেছেন।
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে গ্রে হাউন্ড কুকুর বাচ্চা জন্ম দেয়। বয়স এক থেকে দুই মাস হলেই বিক্রি হয়ে যায়। একটি বাচ্চা ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তপন দাসেরা। দেড় থেকে দুই বছরে একটি কুকুর বড় হয়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক কুকুরের দর বেশি, আকারভেদে একেকটি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। কুকুর বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চলে তাঁদের।
কিন্তু তপন রবিদাসরা কীভাবে পেলেন এই জাতের কুকুর? জানালেন, সরাইল পরগনার জমিদার দেওয়ান মনোয়ার আলী ওরফে মন্নর আলী তাঁর দাদার বাবা কালীচরণ রবিদাসকে খুব আদর-স্নেহ করতেন। এই জমিদার দুটি কুকুর দান করেন তাঁকে। সেই থেকে দাস পরিবার কুকুর পালন আর বিক্রি করে আসছে।
সরাইল উপজেলায় গ্রে হাউন্ড কুকুরের আগমন নিয়ে বেশ কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি গল্প বেশি শোনা যায়। একবার সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেবের কাছে থেকে ওই মাদি কুকুরটিকে নিয়ে আসেন। কয়েক দিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা প্রসব করে। দেখা যায়, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একসময় এসব কুকুর সরাইল গ্রে হাউন্ড নামে পরিচিতি পায়।
সরাইল গ্রে হাউন্ডের একসময় রমরমা বাজার ছিল। তখন অনেক শৌখিন ব্যক্তি গ্রে হাউন্ড কুকুরের বাচ্চা কেনার জন্য গাড়ি হাঁকিয়ে সরাইলে আসতেন। জাতীয় চিড়িয়াখানাতেও দেখা যেত গ্রে হাউন্ড কুকুর। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই অতীত। সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। তপন লাল রবিদাস ক্ষোভ ঝাড়েন, ‘এলাকার জনপ্রতিনিধিরা নানা সময় কথা দিয়ে গেছেন, গ্রে হাউন্ড কুকুরের জন্য একটা কিছু করবেন, কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। পশুচিকিৎসকেরা কোনো দিন কোনো পরামর্শ কিংবা কোনো দিন খোঁজ নিতেও আসেননি। আমরা অতিকষ্টে এখনো এই জাত লালন-পালন কইরা আসতাছি।’