৪৭ বছর পর ৫ বান্ধবীকে যেভাবে এক করল একটা ছবি

সাদাকালো ছবিটা সাত বান্ধবীর। স্কুলে পড়ার সময় তোলা। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তাদেঁর কেউ ভর্তি হয়েছেন ভিন্ন কোনো কলেজে, পরিবারের সঙ্গে কেউ চলে গেছেন অন্যত্র, কারও–বা বিয়ে হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৪৭ বছর কেটে গেছে। তাঁদের পাঁচজনের মধ্যে কীভাবে আবার সেতুবন্ধ তৈরি করে দিল একটা ছবি, সেই গল্পই শোনাচ্ছেন মনজুরুল আলম

হঠাৎ করে সেদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন দিলখোশ বেগম। মানুষ অসুস্থ হলে যেমন প্রিয় কোনো স্মৃতির কাছে ফিরে যায়, দিলখোশ বেগমও ফিরে যাচ্ছিলেন শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির কাছে। যে স্মৃতিতে মিশে ছিল তাঁর স্কুলজীবনের কয়েকজন বান্ধবী। দিনে দিনে যাঁরা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিলেন শুধুই ছবির মানুষ।

অসুস্থ মায়ের মুখে সেদিন ছবির মানুষদের কথা শুনে মেয়ে নাজিন প্রত্যাশার মনটা খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আহা, মায়ের বান্ধবীদের খোঁজ যদি পাওয়া যেত, তাঁর মনটা ভালো হয়ে যেত।

রাতেই পারিবারিক অ্যালবাম থেকে মায়ের হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীদের একমাত্র ছবিটি বের করেন প্রত্যাশা। ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে ছবিটা পোস্ট করে লেখেন, ‘ছবিটি ১৯৭৫ সালের। শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের (নারীশিক্ষা মন্দির) বিদায় সংবর্ধনায় তোলা। (ছবির) নিচে সর্ব বামে আমার আম্মু (দিলখোশ বেগম পুতুল), তার পাশে সেলিনা বেগম পারুল ও সাবেরা বেগম। ওপরে সর্ব বাম থেকে রওশন আরা নিলু, রুবি, ঝুমা ও হাওয়া আন্টি। ওই দিনটাকে স্মৃতিস্বরূপ রাখার জন্য ছবিটি তোলা। আজ কারওর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই।’

রাত সাড়ে নয়টায় দিকে ছবিটা পোস্ট করেন প্রত্যাশা। এক ঘণ্টা পর গ্রুপে পোস্টটা অনুমোদন হয়। মুহূর্তেই অনেক মন্তব্য জমা হয়। প্রত্যাশা তাঁর অসুস্থ মাকে মন্তব্যগুলো পড়ে শোনাতে গিয়ে চমকে ওঠেন। ছবিতে সাবেরা বেগম যাঁর নাম, তাঁরই এক ভাবি মন্তব্য করেছেন। তাঁর মাধ্যমে প্রত্যাশা জানতে পারেন, সাবেরা বেগম ঢাকায় থাকেন। তিনিও অসুস্থ।

সাত বান্ধবীর সাদাকালো সেই ছবি
সংগৃহীত

তারপর একের পর মন্তব্য আসতে থাকে। ছবিটির প্রশংসা করে কেউ কেউ লেখেন, ‘শাশ্বত বাঙালি কন্যা। সহজ সরল সাবলীল। বর্তমান থেকে অনেক আধুনিক’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।/ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।’ কেউ লিখতে থাকেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিন সবাই হারিয়ে যায়’, আশাবাদ ব্যক্ত করে কেউ কেউ লেখেন, ‘আশা করি সবাইকেই খুঁজে পাবেন’, এমন নানা মন্তব্য।

এরই মধ্যে আরেকটি মন্তব্যে আটকে যায় প্রত্যাশার চোখ। নাজিবুর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মন্তব্য করেছেন, ‘এই ছবির সর্ব ডানে যিনি (হাওয়া) তাঁর ছেলে আমি। এবং সর্ব বামে যিনি আছেন নিলু আন্টি, তাঁর সঙ্গেও আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আশা করছি এই একই রকম ছবি আবার খুব দ্রুত আরেকবার তোলা সম্ভব হবে।’

দুজনের খোঁজ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রত্যাশার মা তখন দারুণ খুশি। ছবিটা বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইডি ও পেজ থেকে শেয়ার হতে থাকে। এদিকে প্রত্যাশার চোখে রাতে ঘুম নেই। কিছুক্ষণ পরপর মন্তব্য দেখেন তিনি। এরই মধ্যে দেখেন, একজন লিখেছেন, ‘সবাইকে শুভেচ্ছা, আমি ঝুমা। আমাদের কাছে তখনো সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।’

প্রত্যাশা তাঁর মা দিলখোশ বেগমকে ঝুমা নামের নারীর বর্তমান ছবি দেখান। ফেসবুকে ছবি দেখে অনেকটাই চিনতে পারেন তিনি। ‘তারপর ঝুমা আন্টিকে উদ্দেশ করে একজন লেখেন, আমি নিলু। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। সেদিনই আমরা চারজনকে পেয়ে যাই। আম্মার এত খুশি দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে,’ বলেন প্রত্যাশা।

সেদিন প্রথম দিলখোশ বেগমের কথা হয় ঝুমা আবদুল্লাহর সঙ্গে। দিলখোশ বেগম বলেন, ‘ঝুমাকে বললাম, বল তো আমি কে? ও আমাকে পুতুল বলে ডাকল। ওই নামেই স্কুলে ডাকত। মনের অজান্তেই সেই স্কুলের দুরন্ত বালিকা হয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে মান–অভিমান চলল (হাসি)। কেন আগে কেউ খবর নিইনি। ঝুমা বলল, সে–ও তিন বছর আগে এই একই ছবি পোস্ট করে আমাদের খুঁজেছে। তখন কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়েছে। এখন ভালো লাগছে। হারানো সম্পদ ফিরে পেয়েছি। এক দিনের মধ্যেই চার বান্ধবীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন আমরা শুধুই কথাই বলছি।’

আরও দুই বান্ধবীর খোঁজে আছেন এখন পাঁচ বান্ধবী। চলতি সপ্তাহে তাঁদের দেখা হওয়ার কথা। ঝুমা আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করি, ৪৭ বছর পরে দেখা হবে, দেখা হলে কী করবেন? প্রশ্ন শুনেই হেসে বললেন, ‘সেদিন কী হয় এখনই বলতে পারছি না। সেই অনুভূতি সেদিনই বলব।’