ডুবোযান নিয়ে বাংলাদেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর

অটোমেটেড আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল বা স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান নিয়ে অনেক তরুণই এখন বেশ আগ্রহী। এ–সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক আয়োজনে স্বীকৃতি পেয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষার্থীদের দুটি দল। সবকিছু ঠিক থাকলে, দুই দলই ১৪-১৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় ‘সিঙ্গাপুর অটোমেটেড আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল চ্যালেঞ্জ (এসএইউবিসি) ২০২৫’-এ অংশ নেবে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০টি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে ‘সাস্ট অনুসন্ধান’ ও ‘আইইউবি বঙ্গমেরিন’। বিস্তারিত শুনেছেন নোমান মিয়া

সাস্ট অনুসন্ধান

ই বছর গবেষণা করে দলটি ‘অর্কা’ নামের একটি স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান তৈরি করেছে
ছবি: সংগৃহীত

শাবিপ্রবির ১০ সদস্যের শিক্ষার্থীর দল ‘সাস্ট অনুসন্ধান’। গত দুই বছর গবেষণা করে দলটি ‘অর্কা’ নামের একটি স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান তৈরি করেছে। তাদের উদ্ভাবিত ডুবোযানটি উদ্ধার অভিযান, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার তথ্য সংগ্রহের মতো জটিল কাজ করতে পারে। সাস্ট অনুসন্ধান দলে আছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আদ দ্বীন মাহবুব, নাইনাইউ রাখাইন, নিহাল বেগ, ফারহানুল ইসলাম, আলি তারিক, ইমতিয়াজ আহমেদ, মেহেদী হাসান, ফয়সাল জামান, সাফউয়াত আদিবা ও নুসরাত জাহান। দলের তত্ত্বাবধানে আছেন একই বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শহিদুর রহমান।

অর্কার উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ, প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে উদ্ভাবকদের সঙ্গে কথা হলো। নাইনাইউ রাখাইন বলেন, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অর্কা প্রজেক্টের সূচনা। প্রথম দিকে কোনো পরীক্ষামূলক ল্যাব না থাকায় বেশ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বর্তমানে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের কাজ শেষ করে পরীক্ষা ও সেন্সর ক্যালিব্রেশনের (ইনপুট বা আউটপুট সিগন্যালের সঠিক পরিমাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া) কাজ চলছে।’

আদ দ্বীন মাহবুব বলেন, ‘অর্কাতে বেশ কিছু হার্ডওয়্যার ও ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। পানির নিচে সঠিক চলাচল নিশ্চিতের জন্য থ্রাস্টার মোটর, উন্নত যোগাযোগ পদ্ধতি, নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য রোবোটিক আর্ম (বাহু), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুলস, ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।’

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অর্কার সক্ষমতা বাড়াতে চাই। শাবিপ্রবির ইনোভেশন হাবের একটি স্টার্টআপ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে কিছু ফান্ড পেয়েছি। অর্কার প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এই অর্থ কাজে লাগবে।’ যথাযথ বিনিয়োগ পেলে একটি কার্যকর বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

দীর্ঘ গবেষণা ও পরিশ্রমের পর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নিলেও এখনো অর্থায়নের অনিশ্চয়তায় ভুগছে সাস্ট অনুসন্ধান। এ প্রসঙ্গে নিহাল বেগ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহযোগিতার চেষ্টা করলেও সময় কম থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো অনিশ্চিত। শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, অর্থের অভাবে এবার অংশ নিতে না পারলে ভবিষ্যতে শাবিপ্রবি থেকে এমন প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

আইইউবি বঙ্গমেরিন

বাণিজ্যিকভাবেও কাজ করতে আগ্রহী আইইউবির শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের দলটি
ছবি: সংগৃহীত

সমুদ্রতলের রহস্য উন্মোচনে কাজ করছেন আইইউবির একদল শিক্ষার্থী। ‘আইইউবি বঙ্গমেরিন’ নামের এই প্রকল্পটি তত্ত্বাবধান করছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক সাদিয়া বিনতে আলম, মেহেদী হাসান ও ফয়সাল এম উদ্দিন। পরিচালকের দায়িত্বে আছেন একই বিভাগের অতিথি শিক্ষক নূর-ই সাদমান। শিক্ষার্থীদের দলে আছেন তাহফিজুল হাসান, রাহাত হাসান, মো. হানা সুলতান চৌধুরী, মুকুট প্রতিম, মো. আব্দুন ফাত্তাহ লাম, হাসিন মাহির, ফয়সল দূর্লভ, উম্মে আইমান, মেহেনাজ আলমগীর, তানফিয়া খান ও মায়মুনা রহমান।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাব ল্যাবে বঙ্গমেরিনের নকশা ও প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। পানির নিচে কঠিন পরিবেশে বিভিন্ন জটিল কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম এই স্বয়ংক্রিয় যান। মাছের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ ও আবাসস্থলের মানচিত্র তৈরি, সামুদ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম এবং নৌ নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা।

বঙ্গমেরিন প্রকল্পটি ২০২৩ সালে শুরু হয়। বর্তমানে প্রকল্পের হার্ডওয়্যার অপটিমাইজেশন, সফটওয়্যার উন্নয়ন, নতুন সেন্সর ইন্টিগ্রেশন এবং গভীর পানির নিচে কাজ করার জন্য ডুবোযানটিকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গমেরিনে ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে—পানির নিচে গভীরতা শনাক্তের জন্য আলট্রাসনিক সোনার, যান্ত্রিক হাত, অত্যাধুনিক ক্যামেরা ইত্যাদি। রাহাত হাসান বলেন, ‘আমাদের এই ডুবোযানে উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম, মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম এবং আধুনিক সেন্সর প্রযুক্তি সংযুক্ত রয়েছে। ফলে এটি জটিল পরিস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে সক্ষম।’

আইইউবি বঙ্গমেরিন দলের পরিচালক নূর-ই সাদমান বলেন, ‘ডিভাইসটি তৈরির জন্য দীর্ঘ গবেষণা, প্রোটোটাইপিং ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্ভব হলে এটি বাংলাদেশের মৎস্য, সামুদ্রিক পরিবেশ ও নৌ নিরাপত্তায় বড় পরিবর্তন আনতে পারবে।’

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবেও তাঁরা কাজ করতে আগ্রহী। সামুদ্রিক অনুসন্ধানের জন্য এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ডুবোযান তাঁরা তৈরি করতে চান, যা ৩০০ মিটার গভীরেও যেতে পারবে।