এইচএসসির ফলাফলে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে কেন

এইচএসসিতে মেয়েরা এগিয়ে থাকছে, এটা নিশ্চয়ই সুসংবাদ। তবে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে কেন? কারণ অনুসন্ধান করতে বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১০ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে। ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রুবাইয়াৎ জাহান

প্রথাগত পথের বাইরে গিয়েও ক্যারিয়ার গড়তে চেষ্টা করছেন অনেকে। ছবিটি এইচএসসির ফল প্রকাশের পর নটর ডেম কলেজে তোলা
ছবি: দীপু মালাকার

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রসঙ্গ তুলেছেন, আমি মনে করি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন ছেলেরা পিছিয়ে পড়ল, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। শুধু সংখ্যাগত নয়, গুণগত বিবেচনাও এখানে জরুরি।

করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতি সম্ভবত এসএসসি-এইচএসসিতে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে বড় কারণ। আমরা জানি, করোনার পর অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এ কারণে ছেলেরা হয়তো পরিবারকে সাহায্য করতে বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। অর্থ উপার্জনের পেছনে সময় দিতে গিয়ে তারা হয়তো পড়াশোনা থেকে সরে এসেছে। আবার আমরা মানি বা না মানি, করোনার সময় ছেলেমেয়ে সবাই-ই পড়াশোনার পরিবেশ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, এটিও কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন

পাসের হারে ছেলেদের অনুপাত শহরে বেশি কমেছে, না গ্রামে? শুধু ছেলেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেরা বেশি খারাপ করছে? নাকি মেয়েদের স্কুল-কলেজে তারা ভালো করছে বলছে সংখ্যায় এগিয়ে থাকছে? এসব গুণগত দিক যাচাই করা দরকার।

ছেলেরা প্রথাগত পড়াশোনা থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, এমনটাও বলা যেতে পারে। যেমন আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই আমি দেখি, এখন অনেকেই পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন পেশাগত সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করে। কেউ ফ্রিল্যান্সিং করে, কেউ হয়তো উদ্যোক্তা। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে পড়াশোনা থেকে সরে যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর হয়ে পড়া। সোশ্যাল মিডিয়াকেও কেউ কেউ আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে।

এসবের বাইরে রাজনৈতিক একটা প্রভাব থাকতে পারে। এটা আগে ছিল না। এখন দেখা যায়, স্কুলপর্যায় থেকেই অনেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। তবে মূল বিষয়, সবার দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন এসেছে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর নিজের মতো করে তারা নিজেদের তৈরি করতে চাচ্ছে। হয়তো চাকরির বাজারের জন্যই নিজেদের তৈরি করছে, কিন্তু চিরাচরিত পথে নয়, একটু অন্যভাবে। কেউ গ্রাফিক ডিজাইন করছে, কেউ ফটোগ্রাফির কাজ করছে, এগুলোকে অবশ্য স্বশিক্ষণই বলব।

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় কিন্তু মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিকস—সংক্ষেপে আমরা যাকে বলি এসটিইএম, এ ক্ষেত্রে মেয়েরা সংখ্যায় কম। একে দুই ভাবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশই মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করে না। কারণ, আমরা ধরেই নিই, ছেলেরা আয় করবে মেয়েরা সংসার সামলাবে, এটাই নিয়ম। দ্বিতীয়ত, আমাদের ধারণা চাকরির উচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নারীরা যথেষ্ট সক্ষম নন। এসব সামাজিক বলয় নারীদের মনোবল ভেঙে দেয়। আরও বিভিন্ন কারণ আছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রুবাইয়াৎ জাহান
ছবি: সংগৃহীত

হয়তো পাঠ্যক্রমে বড় পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। হয়তো আমাদের এখনকার পাঠ্যক্রমে ছেলেমেয়েরা আর আগ্রহ পাচ্ছে না, কারণ তা যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ফলে তারা হয়তো নিজেদের মতো করে পথ তৈরি করে নিচ্ছে। কাজের ক্ষেত্রে যেসব নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলোর কথা মাথায় রেখেই পাঠ্যক্রম নতুন করে সাজানো দরকার।