৭৫ বছরের জীবনে প্রথম সামনাসামনি ট্রেন দেখে বললেন, ‘রেলগাড়ি দেখার স্বপ্ন পূরণ হইল’

ট্রেনে ওঠা তো দূরে থাক, ৭৫ বছরের জীবনে সামনাসামনি কোনো দিন ট্রেন দেখেননি। তাই ১০ অক্টোবর সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন ট্রেন দেখবেন বলে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে উদ্বোধনী ট্রেনটি দুই চোখ ভরে দেখলেন জাজিরার নূর মোহাম্মদ সিকদার। তাঁর কাছে প্রথম ট্রেন দেখার অনুভূতি জানলেন সত্যজিৎ ঘোষ

নূর মোহাম্মদ সিকদার
ছবি: প্রথম আলো

আমি গ্রামের মানুষ। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে মেসের আলী মুন্সীকান্দি গ্রামে আমার বাড়ি। পাশেই পদ্মা। জীবনে বহুবার নদীর ভাঙন দেখছি। ঠিকানাও বদলাইতে হইছে বারবার। চরাঞ্চলে বড় হইছি বাপ-দাদার সাথে খেতে-খামারে কাজ করে। কোনো দিন স্কুলে যাওয়া হয় নাই। গ্রামে পায়ে হাঁটার রাস্তা ছিল। আর নৌকায় করে দূরে যাইতাম। ঢাকাতেও গেছি কয়েকবার, নৌকায় করে।

এরপর ঢাকার সাথে যোগাযোগ সহজ হইল। বিভিন্ন সময় ঢাকায়ও গেছি। কিন্তু রেলগাড়ি চলাচল করে এমন এলাকায় আত্মীয়স্বজন নাই যে গাড়িতে চড়ব। আবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো দিন স্টেশনে গিয়ে রেলগাড়ি দেখারও সুযোগ হয় নাই। এই জন্য নাটক-সিনেমা ছাড়া বাস্তবে কোনো দিন রেলগাড়ি দেখি নাই।

মাওয়া থেকে ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে ট্রেন
ছবি: দীপু মালাকার

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পাশের গ্রাম দিয়ে রেললাইনের কাজ হইতেছিল। যাওয়া–আসার সময় অনেকবার দেখছি রেললাইন। এরপর শুনলাম মাঝেমধ্যে রেলগাড়িও আসছে। কিন্তু কখন আসে, কখন যায়, সেটা তো আর আমার মতো বুড়া মানুষের জানা সম্ভব না। তাই প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের খবর শোনার পর থেকেই আগ্রহ নিয়ে ছিলাম।

গত মঙ্গলবার ছিল সেই দিন। গ্রামের মানুষ আমরা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করি। সেদিনও ঘুম থেকে উঠে বাড়ির টুকটাক কাজ সেরে ফেলি। সকালের খাবার খেয়ে রওনা দেই নাওডোবা জমাদ্দার মোড়ের দিকে। বাড়ি থেকে জায়গাটা দুই কিলোমিটার। সকাল ৯টার মধ্যেই পৌঁছে যাই। ওই খান থেকেই রেলপথ দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন, তাই নিরাপত্তার কারণে আমাদের একটু দূরে থাকতে বলা হইছিল। মনের ভেতর অজানা এক আনন্দ। যে গাড়ি জীবনে কখনো দেখি নাই, শুধু গল্পে শুনছি, তা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে, ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল।

সকালেই অনেক রোদ উঠছিল। রোদের মধ্যেই বসে থাকলাম। আমার মতো আরও অনেক মানুষই আশপাশের এলাকা থেকে গাড়ি দেখতে আসছে। তাদের সাথে গল্পগুজব করলাম। এভাবে চার ঘণ্টা বসে কেটে গেল। বেলা একটার পর হঠাৎ হুইসেল বেজে উঠল। হুইসেল শুনে মানুষজন চিৎকার দিয়ে উঠল। একটু পরই আমাদের সামনে ট্রেনটা চলে এল। ফসলের মাঠের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে চলে গেল। আমার মতো শত শত মানুষ আনন্দে হাততালি দিলাম।

আমার রেলগাড়ি দেখার স্বপ্ন পূরণ হইল। এখন আরেকটা স্বপ্ন আছে। আমার বাড়ি থেকে শিবচরের কুতুবপুরে পদ্মা স্টেশনের দূরত্ব ৪-৫ কিলোমিটার। এই স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকা যাওয়ার খুব ইচ্ছা।