এই শীতে কোন ক্যাম্পাস কোন উৎসবে মেতেছে
শীত মানেই উৎসবের মৌসুম। দিনভর মেলা, রাতভর কনসার্ট—ক্যাম্পাসগুলোয় চলছে নানা আয়োজন। সাম্প্রতিক এমনই কয়েকটি অনুষ্ঠানের খোঁজ জানা যাক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আইনে পৌষপার্বণ’
নাম শুনে চট করে মনে হতে পারে, পৌষপার্বণের আইন নিয়ে কিছু বলা হচ্ছে! আদতে তা নয়। ‘আইনে পৌষপার্বণ’ শিরোনামে দারুণ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স প্রাঙ্গণে গান, নাচ, কবিতার আয়োজন ছাড়াও ছিল পিঠাপুলিসহ খাবারের বিভিন্ন স্টল। সার্বিক আয়োজন সম্পর্কে আইন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী অনিন্দ্য দাস বলেন, ‘আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা যে কী অসম্ভব মেধাবী, সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত, সেটা পৌষপার্বণ না হলে বুঝতাম না। আমরা পৌষপার্বণকে একটি স্বতন্ত্র পার্বণ হিসেবেই প্রতিবছর পালন করতে চাই, যা নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা চাই পৌষপার্বণ হবে আইন বিভাগের প্রতিটি শিক্ষার্থীর পার্বণ। পৌষপার্বণ আয়োজনটির বিশেষত্ব হলো, এখানে একটি থিমভিত্তিক চিত্রকর্মের প্রদর্শনীও হয়। এ বছর চিত্রকর্মের থিম ছিল উত্থান।’ আয়োজন উপলক্ষে সপ্তাহজুড়েই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া, সাজসজ্জা ও তহবিল সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষার্থীরা।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কুহেলিকা উৎসব
উৎসবমুখর পরিবেশে ২২ থেকে ২৪ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো কুহেলিকা উৎসব। আয়োজনটিকে একটি সাংস্কৃতিক মিলনমেলা বলে দাবি করছে সাংস্কৃতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন অভয়ারণ্য। সাংস্কৃতিক এই আয়োজনে বিতর্ক, গান, নাচ, আবৃত্তি, মূকাভিনয় ছাড়াও ছিল বেশ কয়েকটি স্টল। স্টলগুলোকে পাটিসাপটা, চিতই, ভাপা পিঠাসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার ও পণ্যে সাজিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকটি সংগঠনও উৎসবে অংশ নেয়। যেমন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি আয়োজন করে জুটি বিতর্ক, মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বে ছিল গান। ‘আবৃত্তি আবৃত্তি’ সংগঠনের সদস্যরা কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করেছিল। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ড্যান্সিং অ্যাসোসিয়েশন পরিবেশন করে নাচ।
অভয়ারণ্যর সভাপতি ইশতিয়াক ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই উদ্যোক্তাদের একটা জায়গা করে দেব। যেন নিজেদের প্রচার–প্রসার করতে পারেন তাঁরা। সেটিই হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা মৌলিক গান, কবিতা ও নাচে দক্ষ—তাঁদের সবার সামনে তুলে ধরা। উৎসবে এত মানুষ দেখে মনে হচ্ছে সবকিছু সার্থক হয়েছে।’
বুটেক্সে হিম উৎসব
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীদের সাহিত্য চর্চার সংগঠন বুটেক্স সাহিত্য সংসদ। সংগঠনটির কর্মকাণ্ড শুধু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করে সুষ্ঠু মননের বিকাশেও কাজ করে তাঁরা। হিম উৎসব সেই প্রচেষ্টারই অংশ। সিনে-বায়োস্কোপ, পিঠা বিক্রি, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, শীতবস্ত্র বিতরণ ছাড়াও ছিল নানা আয়োজন। হিম উৎসবে মোট ১৫টি স্টল ছিল। স্টলগুলোয় ছিল বিভিন্ন পদের পিঠা যেমন নকশি, ভাপা, দুধচিতই, পাটিসাপটা। পাশাপাশি খেজুর রসের পায়েস, হাওয়াই মিঠাই, ফুচকা, আচার, ইত্যাদি নিয়েও বসেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে ধারাবাহিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে উৎসব। বেলা একটায় বুটেক্স সাহিত্য সংসদের ত্রৈমাসিক পত্রিকা চৈতন্য লিপির রবীন্দ্র সংখ্যার মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। এরপরই পিঠাপুলির স্টলগুলো খুলতে শুরু করে। একই সঙ্গে টিএসসিতে শুরু হয় সিনে বায়োস্কোপ। সিনে বায়োস্কোপে প্রদর্শনী হয় আলোচিত দুটি চলচ্চিত্র—মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ আর তারেক মাসুদের রানওয়ে। বুটেক্স সাহিত্য সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়াজুর রহমান বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে।’ সাংস্কৃতিক আয়োজনে নাচ, গান, পুঁথি পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, পুতুলনাচ পরিবেশন করেন শিক্ষার্থীরা। রাত নয়টায় তরুণ সংগীতশিল্পী অর্ঘ্য দেবের পরিবেশনা দিয়ে শেষ হয় উৎসব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা আয়োজন
শীতজুড়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে নানা অনুষ্ঠান-উৎসব। তবে ‘ইন্ডিজেনাস ফুড ফেস্টিভ্যাল’–এর কথা আলাদা করে বলতেই হই। ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি এক রকম চ্যালেঞ্জ নিয়েই প্রথমবার ক্যাম্পাসে এই উৎসব করেছিলেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন শিক্ষার্থী। উদ্দেশ্য ছিল—ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। আয়োজনটি সেবার বেশ সাড়া ফেলেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও ২৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে অনুষ্ঠিত হলো ‘ইন্ডিজেনাস ফুড ফেস্টিভ্যাল’। স্টল ছিল ১০টি। ম্রো, গারো, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ঐতিহ্যবাহী সাজে, নিজস্ব পিঠা-খাবার ও সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে উৎসবে অংশ নেন। আয়োজক দলের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী মুন চাকমা জানালেন, সান্ন্যে পিধে, কলা পিধে, আলসি পিরা, মূ-পিরা, লাকসু, মুন্ডি, পাজন, হুরো গোরাঙ, মাছ গোরাঙ, শামুক, দ-ফুরা খারি, দ-গপ্পাসহ আরও অনেক বৈচিত্র্যময় খাবার ও পিঠা ছিল খাবারের এই মেলায়। সেই সঙ্গে ছিল চারুকলার শিক্ষার্থী সুরজয় চাকমার আঁকা ছবি নিয়ে চিত্র প্রদর্শনী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের নাচগান-আবৃত্তি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবছর পিঠা উৎসব করে। অ্যাপ্লাইড আর্ট বিভাগের শিক্ষার্থী এশনা বিনতে আলী বলছিলেন, ‘করোনা–পরবর্তী কয়েক বছর পিঠা উৎসব বন্ধ ছিল। এ বছর আবার যখন আমরা উৎসবটি করার কথা চিন্তা করি, তখন ভিন্নতা আনতেই নাম দিই “হিমসংক্রান্তি ১৪৩০”।’ দ্বিতীয় বর্ষের আয়োজন হলেও অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উৎসবটি নাচের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। শেষে ছিল কবিতা আবৃত্তি, পুঁথিগান, ছায়ানৃত্য, বিটবক্সিংসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
চুয়েটে পিঠা, গান, নাটক, আরও কত–কী
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাংস্কৃতিক সংগঠনটির নাম জয়ধ্বনি। এই সংগঠনের উদ্যোগেই গত ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে হিম উৎসব-১৪৩০। সেদিন ক্যাম্পাসে বসেছিল নানা রকম পিঠাপুলির স্টল। স্টল সাজাতে ব্যবহার করা হয়েছে মাটির হাঁড়িপাতিল, কুলা, হাতপাখা, বাঁশের ছনসহ গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন উপাদান ও নকশা। জয়ধ্বনি চুয়েটের কার্যকরী সদস্য অর্পণ দাশ গুপ্ত জানান, স্টল তৈরির জন্য দিনরাত এক করে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন শিক্ষার্থীরা। স্টলে ভাপা, চিতই, দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, নকশি, ঝাল পিঠা, পাটিসাপটা, ছাঁচ পিঠা ছাড়াও নানা পদের পিঠা ছিল। অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ, জারি, সারি, বাউলগানসহ বিভিন্ন লোকগানের আয়োজন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প তোতাকাহিনী অবলম্বনে অনুষ্ঠিত নাটক মুগ্ধ করেছে দর্শককে। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ছিল গ্রামবাংলার বিখ্যাত লোককাহিনি–সংবলিত পুঁথিপাঠ। কমলা সুন্দরী ও কালা ঘটকের বহুল প্রচলিত এই পুঁথি পরিবেশটাই বদলে দিয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর কুয়াশা উৎসব
শীত এলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তৈরি হয় কুয়াশা উৎসবের জন্য। এ বছর এই আয়োজন হলো ২ ফেব্রুয়ারি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার উদ্যোগে ক্যাম্পাসে কুয়াশা উৎসব হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। জাহাঙ্গীরনগর বন্ধুসভার সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘কালের বিবর্তনে আমাদের সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে আমরা সেই দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।’ এই উৎসবের ভিন্নতা হলো, এতে পিঠাপুলি বা অন্য কোনো পণ্যের স্টল ছিল না। কেবল সাংস্কৃতিক পরিবেশনাই ছিল একমাত্র আয়োজন। তাই বলে খালি মুখে সবাই বসে ছিল, এমনটা ভাবারও কারণ নেই। গিয়াস উদ্দিন বিষয়টি খোলাসা করলেন, ‘স্টল না থাকলেও নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে আমরা ভাপা, চিতই পিঠা ও খিচুড়ি-মাংসের ব্যবস্থা করি। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন তো ছিলই। সেখানে গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তি হয়েছে।’ বিকেলে শুরু হয়ে রাত ১০টায় শেষ হয় এ আয়োজন।