তিন যুগ আগে রোগীদের সেবা দিতে যেভাবে যাত্রা শুরু করে ল্যাবএইড
এমবিবিএস করার পর পেশাগত জীবন শুরু করতেই এম এ শামীম খেয়াল করেন, দেশে মানসম্মত সেবা দেওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জিং। চিকিৎসকেরা আস্থা রাখতে পারেন, এমন ল্যাব খুঁজে পাওয়াটাই মুশকিল। সেই ভাবনা থেকে ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে তিনি এমন একটি উদ্যোগ নেন, যাতে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক একই জায়গায় সেবা দিতে পারেন। সেখান থেকে ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
১৯৮৯ সালে ডায়াগনস্টিক সেন্টার হিসেবে যাত্রা শুরু করে ল্যাবএইড। এক ছাদের নিচে হৃদ্রোগীদের বিশেষায়িত সেবা দিতে ২০০৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল। এরপর ২০০৬ সালে ঢাকায় সব রোগের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বিশেষায়িত ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল। চট্টগ্রামেও রয়েছে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল। দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শাখা। ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার এই প্রতিষ্ঠানের আধুনিকতম সংযোজন। বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রয়াসেই ল্যাবএইডের এই দীর্ঘ পথচলা।
দিনে-রাতে জরুরি সেবা
আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ হার্ট অ্যাটাক। উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে পারলে বেঁচে যায় অমূল্য প্রাণ। এ জন্য প্রয়োজন এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে দ্রুততম সময়ে এনজিওগ্রাম করা যায়। এনজিওগ্রাম দেখে দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন একজন বিশেষজ্ঞ। নেওয়া হয় স্টেন্টিং বা রিং পরানোর মতো ব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে দিনে-রাতে যেকোনো সময় হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ দেখা দিলে এত সব ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় সে অর্থে দেশে ছিলই না। অথচ হুট করে হার্ট অ্যাটাকের মতো মারাত্মক সমস্যা হতে পারে যে কারও। কম বয়সীদেরও রয়েছে এমন বিপদের ঝুঁকি। বিপন্ন জীবন বাঁচাতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অবিরাম সেবা দিয়ে চলেছে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল। শিশুর জন্মগত ত্রুটি সংশোধনসহ হৃৎপিণ্ডের সূক্ষ্ম ও জটিল শল্যচিকিৎসা যত্নসহকারে সম্পন্ন হচ্ছে।
‘উইনিং ক্যানসার’
ক্যানসার এমন এক রোগ, যাতে কেবল একজন রোগীই ভোগেন না, নানাবিধ ভোগান্তিতে পড়ে পুরো পরিবার। রোগীর শারীরিক কষ্টটা অপরিমেয়। মানসিক আর আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে বহু পরিবার। কম খরচে চিকিৎসা পেতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যান ক্যানসারে আক্রান্ত বহু মানুষ। কিন্তু উপচে পড়া ভিড় ঠেলে চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। অথচ সময়মতো চিকিৎসা করালে নিরাময় হয় বহু ক্যানসার। ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের মূলমন্ত্র ‘উইনিং ক্যানসার’। ক্যানসার মানেই জীবনের শেষ নয়। ক্যানসারের সঙ্গে লড়েও জয়ী হন বহু মানুষ। আর লড়াইয়ের পরও যাঁদের মেনে নিতে হয় মৃত্যুর পরিণতি, তাঁদের এই মৃত্যুও যেন হয় উপশমমূলক। এমনটা যেন না হয় যে হাল ছেড়ে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর জন্য ভয়ার্ত চোখে প্রতীক্ষা করছেন একজন মানুষ। এমন ভাবনাকে উপজীব্য করেই এই বিশেষায়িত সেন্টারে সেবা দেন কর্মীরা।
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা
বর্তমানে স্ট্রোক বাংলাদেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। স্ট্রোক–পরবর্তী সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি যেমন থ্রম্বোলাইসিস ও থ্রম্বেকটমিও হচ্ছে ল্যাবএইডের অত্যাধুনিক স্ট্রোক সেন্টারে। আর মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ল্যাবএইডের অত্যাধুনিক নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ও সিসিইউ তো আছেই।
হৃদ্রোগ ও ক্যানসার ছাড়াও এখানে পাবেন যেকোনো সমস্যার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের খোঁজ। দীর্ঘদিন ধরে হিপ জয়েন্ট (ঊরুসন্ধি) বা নি জয়েন্ট (হাঁটু) প্রতিস্থাপনের কাজটি সাফল্যের সঙ্গে হয়ে আসছে এই প্রতিষ্ঠানে। প্রসবকালীন জটিলতা মোকাবিলায় রয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনসহ (আইভিএফ) বন্ধ্যত্বের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা এখানে আছে। সাফল্যের হার উন্নত বিশ্বের মতোই।
ধারাবাহিকতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি
কলেজ অব আমেরিকান প্যাথলজিস্টের (সিএপি) স্বীকৃতি পেয়ে আসছে ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ল্যাবরেটরির মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার এটি একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডের (বিএবি) তালিকার সেরার মধ্যেই থাকে ল্যাবএইড। রয়েছে আন্তর্জাতিক আরও নানা স্বীকৃতি। ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের রয়েছে জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনালের (জেসিআই) স্বীকৃতি। চট্টগ্রামের ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল আবার আমেরিকান অ্যাক্রেডিটেশন কমিউনিকেশন কাউন্সিল (এএসিআই) স্বীকৃতির শেষ ধাপে আছে। ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর হসপিটালস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোভাইডারসের (এনএবিএইচ) স্বীকৃতি পেয়েছে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল এবং ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ
জীবন বাঁচাতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন এক গুরুত্বপূর্ণ শল্যচিকিৎসা। ২০১০ সালে লিভার প্রতিস্থাপন শুরু করে ল্যাবএইড হাসপাতাল। ছয়জন রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করা হয় সে সময়। নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপনও হয়েছে। পরে বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনবিষয়ক নীতিমালার জটিলতায় পড়ে থমকে গেছে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশ থেকে বহু রোগী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য বাইরে যান। বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ প্রতিস্থাপন নীতিমালাও প্রশ্নবিদ্ধ। তবু বাধ্য হয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানেই ছুটছেন মানুষ। সরকারিভাবে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে রোগীরা এ ধরনের বিশেষায়িত সেবা পাওয়ার সুযোগ দেশেই পাবেন। ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো জটিল শল্যচিকিৎসার জন্য যে দক্ষ লোকবল ও বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, সবই তাদের আছে। কেবল সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।
স্বপ্ন যখন রোবোটিক শল্যচিকিৎসা
বিশ্বে জনপ্রিয় হচ্ছে রোবোটিক শল্যচিকিৎসা। আধুনিকতম এই প্রযুক্তির ব্যবহারে জটিল সব শল্যচিকিৎসায় সাফল্যের হারও বাড়ছে। দেশের বাইরে এই চিকিৎসার জন্য যে খরচ হবে, তার এক–পঞ্চমাংশ খরচে দেশেই করা সম্ভব এমন চিকিৎসা। দেশের মানুষের জন্য তেমন দারুণ কোনো সুযোগ সৃষ্টির আশা নিয়েই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছে ল্যাবএইড।