ক্যারিয়ার গড়লে কি পরিবার গড়া যায় না?

পরিবার ও ক্যারিয়ারকে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে না বসিয়ে নিজের জীবনে আনতে হবে ভারসাম্য। মডেল: মাশিয়াত
ছবি: কবির হোসেন

ছোটবেলায় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন প্রায় সবাই, ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ জীবনের লক্ষ্য নিয়ে রচনা লেখার কথাও হয়তো কমবেশি সবার মনে আছে। মানুষের মতো মানুষ হওয়া কিংবা পরিবারের প্রতি অনুভূতিশীল মানুষ হওয়ার কথা আমরা তেমন বলি না। শৈশব থেকেই আমাদের কথোপকথন আর রচনা লিখন দুই-ই পেশাকেন্দ্রিক। তবে কেবল পেশাদার জীবনের সাফল্য একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করায় না। পরিবারও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

অফিস, মিটিং, প্রেজেন্টেশনের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে অধুনা যোগ হয়েছে অনলাইন মিটিংয়ের মতো ডিজিটাল কর্মকাণ্ড। ঘরে থাকলেও হয়তো মাথার ভেতর গিজগিজ করে পরদিনের কর্মপরিকল্পনা। পরিবার নিয়ে বাইরে ঘুরতে বেরিয়েও ধরতে হয় অফিসের ফোন। আবার সন্তানকে স্কুলে দিতে গিয়ে কিংবা বৃদ্ধ বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের অফিসে দেরি করে ঢোকার মতো উল্টো চিত্রও দেখা যায়। কোনোটিই কাম্য নয়। বরং পরিবার ও ক্যারিয়ারকে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে না বসিয়ে নিজের জীবনে আনতে হবে ভারসাম্য।

সময়ের এক ফোঁড়

আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মানবসম্পদ বিভাগের সমন্বয়ক তাসনিম ফারজানা ভাগ করে নিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। শোনালেন একই সঙ্গে কীভাবে সামলাচ্ছেন পরিবার ও ক্যারিয়ার। মা হওয়ার আগে কর্মঘণ্টার বাইরেও স্বেচ্ছায় কর্মস্থলের বাড়তি দায়িত্ব পালন করতেন তিনি, অনলাইনে খেয়াল রাখতেন অফিসের নানান দিক। কিন্তু মা হওয়ার পরের জীবনে সন্তানের জন্য রাখা সময় থেকে কর্মস্থলকে আর আগের মতো বাড়তি সময় দিতে পারেন না। প্রতিষ্ঠানকে নিজের এই বাস্তব পরিস্থিতির কথা জানিয়েও রেখেছেন তিনি, তাই কর্মস্থল থেকেও কর্মঘণ্টার বাইরে নিতান্ত জরুরি না হলে ফোন আসে না তাসনিমের কাছে। কাজের সময় নিজেকে যেমন উজাড় করে দেন, তেমনি কাজের পরের সম্পূর্ণ সময়টাই পারিবারিক। মুঠোফোন থেকে অফিসের ই–মেইল দেখার অপশনটিও বন্ধ করে রেখেছেন। বাড়ি ফিরে কন্যার সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে চেষ্টা করেন। তিন বছর বয়সী কন্যার সঙ্গে খেলাধুলা তো করেনই, ঘুমের আগে তার সঙ্গে বই পড়েন।

সময় ব্যবস্থাপনা

সকালে একটু সময় হাতে নিয়েই বের হন তাসনিম ফারজানা। কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কন্যাকে নামিয়ে দেন শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে (ডে–কেয়ার সেন্টার), কাজ শেষে তাকে নিয়ে ঘরে ফেরেন। ফেরার পথে বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও সেরে নেন। মা-বাবা যখন রাতের খাবার খেতে বসেন, তখন তাঁদেরও একটু সঙ্গ দেন। ছুটির দিনগুলোতে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে এমন কোথাও আড্ডা দেন, যেখানে সবার সন্তানেরা একসঙ্গে খেলাধুলার সুযোগ পায়। মা-বাবার জন্য প্রায়ই বাইরে থেকে খাবার আনেন ছুটির দিনে। সেসব খেতে খেতে সবাই মিলে সময় কাটান পারিবারিক পরিবেশে।

অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করে নেওয়া ভালো। মডেল: মাশিয়াত
ছবি: কবির হোসেন

খেয়াল রাখুন

  • পরিবার ও ক্যারিয়ারের জন্য সময় রাখুন আলাদা। সময়ের কাজ সময়ে সেরে ফেলুন। তাহলে সময়ের পর তেমন পিছুটান অনুভূত হবে না।

  • কর্মস্থলে মনোযোগী থাকুন, পারিবারিক সময়টাও পরিবারের সবার জন্য উপভোগ্য করে তুলুন।

  • কাজের বিরতিতে পরিবারের খোঁজ নিন। পারিবারিক সময়ে অফিসের জরুরি ফোন এলেও সংক্ষেপে কথা সারতে চেষ্টা করুন।

  • পরিবারের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিন। ঘরের কাজে একে অন্যকে সাহায্য করুন। ফলে নিজেদের একান্ত সময়টুকু বাড়িয়ে নিতে পারবেন।

  • স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঘরের বাইরে কাজ করলে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই বোঝাতে হবে যে মায়ের কাজটিও প্রয়োজনীয়। ‘মা তোমাকে ফেলে চলে গেল,’ এমন কথা পরিবারের কেউ যেন না বলেন। আর শিশুকে এমনভাবে গড়ে তুলুন, যাতে মায়ের ক্যারিয়ার তার জন্যও একটি গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

  • কর্মজীবী মা-বাবাদের সন্তান দেখভালের দায়িত্বটা অনেক ক্ষেত্রেই দাদি-নানি পালন করে। অবশ্যই খেয়াল রাখুন, যাকে এই গুরুদায়িত্ব দিচ্ছেন, তাঁর কোনো সাহায্যকারী প্রয়োজন কি না।

জরুরি পরিস্থিতিতে

সন্তান অসুস্থ হলে সেটি যেমন কর্মস্থলে জানিয়ে রাখেন তাসনিম ফারজানা, তেমনি অফিসে কাজ সারতে হঠাৎ কোনো দিন দেরি হয়ে গেলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রটিতেও জানিয়ে রাখেন তাঁর দেরির বিষয়টি। শারীরিক অসুস্থতা, যানজট, কাজের চাপ—এমন নানান কারণে কর্মক্ষেত্র কিংবা পরিবারের নিয়মিত কাজের বিঘ্ন ঘটতে পারে। বিরক্ত না হয়ে দক্ষ হাতে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কর্মস্থলের জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকলে আগে থেকেই পরিবারে জানিয়ে রাখুন। একান্ত প্রয়োজনে আপনার সন্তান কিংবা পরিবারের অন্য কারও কাছে আপনার এমন কোনো সহকর্মীর নম্বর দিয়ে রাখুন, যিনি জরুরি তথ্যটি আপনাকে পরে জানিয়ে দেবেন।