সাবিনাদের শিক্ষক এই রাফিয়া বেগম

শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ১১ অক্টোবর গানের শিক্ষক কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, অঙ্কনের শিক্ষক শিল্পী রফিকুন নবীর পাশাপাশি শরীরচর্চার শিক্ষক রাফিয়া বেগমকে সম্মাননা জানায় দৃশ্যপট নাট্যদল। প্রথম দুজনকে স্বনামেই চেনে দেশের মানুষ। কিন্তু নিজ জেলার বাইরে খুব কম লোকই জানে রাফিয়া বেগমের নাম। নিভৃতচারী মানুষটার খোঁজ পাবেন এখানে

জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনার মতো অনেকের শিক্ষক এই রাফিয়া বেগম (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকায় তিনতলা বাড়ির দোতলায় একাই থাকেন রাফিয়া বেগম। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন। কানেও কম শোনেন। তবে এখনো কারও ওপর নির্ভর করে চলতে পছন্দ করেন না। বাজার করা থেকে শুরু করে নিজের সব কাজ নিজেই করেন।

গত রোববার সকাল আটটায় রাফিয়া বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ফটকে তালা ঝুলছে। মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া গেল না। তাঁর বাড়ির ভাড়াটে, আশপাশের বাড়ির মানুষ, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সন্ধান পাওয়া গেল না। প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা করে অনেকটা হতাশ হয়ে ফিরতে হলো। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আবার তাঁর বাসায় যাওয়া হলো। ওই সময় তাঁকে পাওয়া গেল। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। দেখেই বললেন, ‘শুনেছি তুই এসেছিলি। বাজারে গিয়েছিলাম। মোবাইলটা যে কখন বন্ধ হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি।’

৬৯ বছর বয়সী মানুষটা খেলাধুলার সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিন, অবসরে যাওয়ার আগে ছিলেন শরীরচর্চার শিক্ষক। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ১১ অক্টোবর গানের শিক্ষক কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, অঙ্কনের শিক্ষক বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর পাশাপাশি তাঁকেও সম্মাননা জানায় নাট্যদল দৃশ্যপট। ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে সেই সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

রাফিয়া বেগম বলেন, অসুস্থ থাকার কারণে সম্মাননা নিতে ঢাকায় যেতে পারেননি। তাঁর পক্ষে গিয়েছিলেন মাতয়ারা বেগম ওরফে কেকা। তিনি আরও বলেন, ‘এসব সম্মাননা কিংবা সংবর্ধনা নিয়ে আমার কোনো মাতামাতি নেই।’ কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয় কেকা। এ লেখায় বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সঙ্গে রাফিয়া বেগমের একটি ছবিও জুড়ে দেন কেকা। রাফিয়া বেগমের হাত ধরেই খেলাধুলায় সাবিনার ‘পায়েখড়ি’। এই পোস্টের সূত্র ধরেই ঢাকা থেকে রাফিয়ার খোঁজখবর নেয় দৃশ্যপট।

১৯৫৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরে রাফিয়ার জন্ম। বাবা কাজী রশিদুজ্জামান আর মা ফিরোজা বেগম। সাত বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সাতক্ষীরা শহরের নবারুণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে যোগ দেন রাফিয়া বেগম। ৩৬ বছর ৬ মাস ৯ দিন চাকরি করে অবসরে গেছেন ২০১৪ সালে।

নিজেও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন রাফিয়া বেগম। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে এইচএসসি পড়াকালীন খেলাধুলায় কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। শুধু রাফিয়া নন, তাঁর পরিবারের বাকি সব ভাইবোনও কমবেশি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। চতুর্থ বোন সেতারা বেগম ঢাকা ও খুলনায় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে দীর্ঘদিন নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। একমাত্র ভাই কাজী কামরুজ্জামানও ফুটবলের পাশাপাশি অ্যাথলেটে জেলা পর্যায়ের খেলোয়াড় ছিলেন। নিজে খেলোয়াড় হওয়ায় শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেন রাফিয়া বেগম। পাশাপাশি স্কুলে সমাজ, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিষয়েও পাঠদান করতেন তিনি।

রাফিয়ার হাত ধরে নবারুণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নাম করেছেন। পারভিন, সাবিনা, মনোয়ারা, কবিতাসহ অনেকের গুরু এই ৭০ ছুঁই ছুঁই নারী। ফুটবলারদের নামগুলো সামনে এলেও তিনি মনে করেন, তাঁদের স্কুলের ভলিবল দলটি ছিল সবচেয়ে ভালো। তাঁর নেতৃত্বে বিভাগীয় পর্যায়ে একবার রানার্সআপও হয়েছিল সেই দল। রাফিয়া বেগম বলেন, ‘যারা খেলাধুলা করত, তারা অধিকাংশই ছিল অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। খেলাধুলা করতে গেলে শরীরে যে পুষ্টি দরকার, অধিকাংশ পরিবারই সেটা জোগাতে পারত না। নিজের চাকরিও ছিল অল্প বেতনের। তারপরও সেই টাকা থেকে খেলোয়াড়দের পেছনে ব্যয় করতাম। অনেককে বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়াতাম।’

সাতক্ষীরা নবারুণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। বিদ্যালয়ে পড়াকালীন রাফিয়া বেগমের হাত ধরেই খেলাধুলার জগতে আসেন সাবিনা। ফুটবলের পাশাপাশি ভলিবল, হ্যান্ডবল, ব্যাডমিন্টন, খো খোতেও পারদর্শী ছিলেন সাবিনা।

সব সময় নেপথ্যে থাকতেই ভালোবাসেন রাফিয়া খাতুন। শিক্ষক হিসেবে নানা বিষয় পড়ালেও কখনো প্রাইভেট পাড়াননি, খেলাধুলার জন্য আলাদা কোচিং সেন্টারও খোলেননি। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছেন এবং খেলাধুলা শিখিয়েছেন নিজের সন্তান মনে করে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে যেমন ভয় পেত, একই সঙ্গে সম্মানও করত। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘এখন খুব হাসি পায়, আমি স্কুলে ঢুকলে চারদিক স্তব্ধ হয়ে যেত। কী একটা সময় ছিল তখন!’

১৯৮৭ সালের ১ জুলাই শহরের কামালনগর এলাকার লুৎফর রহমানকে বিয়ে করেন রাফিয়া বেগম। অবসরের পর একসঙ্গে বেশ ভালোই ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। গত বছর স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে একাই থাকেন। নিজের কাজ করে, টেলিভিশন দেখে আর বই পড়ে কাটে তাঁর সময়।

খাটের ওপর বালিশের পাশে রাখা বেশ কয়েকটি আত্মজীবনী ও উপন্যাস। সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই বললেন, ‘পুরস্কার কিংবা সংবর্ধনার জন্য কখনো কাজ করিনি। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি সম্মাননা জানালে তো ভালোই লাগে।’