আমার ব্যর্থতার দায় একাই মাথা পেতে নিলেন মা

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

মায়ের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

 স্কুলে পড়ার সময় খুব খামখেয়ালি ছিলাম। ফলে ক্লাস সিক্সের রেজাল্ট খারাপ হলো। লাস্ট বয় হিসেবে টেনেটুনে সেভেনে পা দিলাম। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার ব্যর্থতার দায় একাই মাথা পেতে নিলেন মা।

পরিবারে আমি বড় ছেলে। আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন। মায়ের দুচোখে নোনা জল। মায়ের কষ্টটা উপলব্ধি করলাম। মা আমাকে স্বপ্ন দেখানো শুরু করলেন। বোঝাতে চাইলেন, চাইলে সব পারে মানুষ।

পড়াশোনার মধ্যে আনন্দ খুঁজতে লাগলাম। টমাস আলভা এডিসন বারবার চেষ্টায় সফল হয়েছিল, সে গল্পে বুঁদ হয়ে আমিও পার করছি দিন মাস বছর।

একদিন ভরবরষায় রেজাল্ট শিট নিয়ে বাড়ি ফিরি, আমি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। আমাদের একান্নবর্তী বাড়িজুড়ে বইল আনন্দের ঝড়। সেদিন আর সবকিছুর ভিড়ে আমি ঠিক দেখেছিলাম মায়ের নয়নজুড়ে নোনা জলের ফিনিক। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর এই নবযাত্রায় মা হয়ে উঠলেন আমার অনুপ্রেরণার প্রধান বাতিঘর।

আরও পড়ুন

আমাকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলল। এভাবে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ হলো। শুরুতে খুব একটা মানিয়ে নিতে পারতাম না। মেডিকেল ছেড়ে দিতে চাইতাম। সেবারও আবার পাশে এসে দাঁড়ালেন মা। আমাকে বোঝার চেষ্টা করলেন। বললেন, থাক খোকা এবার। এই বছরটা যাক।

আমি বললাম, আমি একটু সময় নিই।

মা বললেন, তাই কর।

বিরতির পর ফিরে এসে প্রথম পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করলাম। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। কপালে স্বভাবসুলভ চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করলেন মা।

বছর দুয়েকের মধ্যেই আমাদের জীবনে কালো মেঘ দেখা দিল। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। জগৎ–সংসারে খুব একা আর অসহায় হয়ে পড়লাম আমি আর মা। সপ্তাহান্তে হোস্টেল থেকে ছুটে আসতাম মায়ের কাছে, পড়াশোনার ব্যাপারে মা আমাকে শোনাতেন আশার বাণী। বারবার বোঝাতে চাইতেন, আমাদের এই দীর্ঘশ্বাসের গল্পগুলোই হবে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার চালিকা শক্তি। ক্রমেই মা আমার বন্ধু হয়ে উঠলেন। একবার ঈদে মায়ের জন্য শাড়ি কিনব, কিন্তু আমি তো ঠিকঠাক শাড়ি চিনি না, বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম।

একদিন চিকিৎসকও হয়ে গেলাম। সেদিন মায়ের চোখেমুখে রাজ্যের আনন্দ। ‘এবার আমি সংসারের হাল ধরি, মা কি বলো?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মা বলেন, ‘না বাবা, তোকে যে আরও বড় হতে হবে।’ মা কী চাইছেন বুঝলাম। সময়ের স্রোতে সরকারি চাকরি হলো। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ডি (ডক্টর অব মেডিসিন) পড়ার সুযোগ পেলাম। পাস করে এখন আমি মায়ের কাছে, নিজ জেলা মৌলভীবাজারে।