জেনে নিন
তালবিলাস
তালগাছকে বলা হয় কল্পবৃক্ষ অর্থাৎ এ গাছের কাছে বেঁচে থাকার জন্য যা চাওয়া হয়, তা–ই পাওয়া যায়।
তালগাছ পরিবেশসংকটে প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। জলবায়ু পরিবর্তনে খরায় পুড়ছে মাটি, সংকটে পড়েছে মাটির নিচে থাকা পানিস্তর, বাড়ছে শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো বজ্রপাতের দুর্যোগ। সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে ঠায় একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সেই তালগাছ। পাখিরা তা জানে, অথচ মানুষ জানে না। বাবুই বাসা বাঁধে তালগাছে, বাদুড় ঝোলে তালগাছে, শকুন ও ইগল আশ্রয় নেয় তালগাছে। সারা দিন মাঠে চরে বেড়ানো ময়ূরও রাতে ঘুমায় তালগাছের মাথায়। টিয়া পাখি ডিম পাড়ে তালগাছের ওপরে। এ জন্য কোনো কোনো দেশে তালগাছকে মনে করা হয় শক্তির প্রতীক হিসেবে। কম্বোডিয়ার জাতীয় বৃক্ষ তালগাছ। মহাভারতের যুদ্ধে ভীষ্মের রথের ব্যানারে খচিত ছিল তালগাছের চিহ্ন। ধারণা করা হয়, তালগাছ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ, যার কাছ থেকে আমরা পাই কাঁচা ও পাকা ফল, কাঠ, পাতা, রস, মোম ইত্যাদি।
শতবর্ষী তাল
‘এক পুরুষে রোপে তাল/ অন্য পুরুষি করে পাল। তারপর যে সে খাবে/ তিন পুরুষে ফল পাবে।’ খনার এ বচনটি মোটেই মিথ্যা নয়। একটা তালগাছ বাঁচে ১০০ বছরের বেশি আর লম্বা হয় প্রায় ১০০ ফুট। লাগানোর পর সে গাছে তাল ধরতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। অনেকে এ জন্য তালগাছ লাগিয়ে তার ফল খেয়ে যেতে পারেন না। একটি তালগাছে ২৫ থেকে ৪০টি পাতা থাকে। এত বড় পাতা খুব কম গাছের থাকে। একটা গাছে বছরে ৬ থেকে ১২টি কাঁদিতে ৩০০টি পর্যন্ত তাল ধরে। পুরুষ গাছে ফল ধরে না, পুরুষ ফুলের জটা হয়। জটা কেটে রস নামানো হয়। স্ত্রী গাছে ফল ধরে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের তালগাছে ফুল ফোটে ও রস হয়। দেড় থেকে দুই মাস ধরে পুরুষ পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল ফুটতে থাকে। মার্চ-এপ্রিলে তালের রস নামে। এপ্রিল-মে মাসে কচি তালের শাঁস হয় ও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তাল পাকে। অক্টোবর-নভেম্বরে তালের আঁটি থেকে গ্যাঁজ হয় ও ভেতরে ফোঁপা হয়।
এক গাছ শত কাজ
তামিল কবি থিরুকুন্ডনথাই অরুণাচলমের ‘তাল বিলাসম’ নামে একটি প্রাচীন কবিতা আছে। সে কবিতায় তালগাছের ৮০১টি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তালগাছকে বলা হয় কল্পবৃক্ষ অর্থাৎ এ গাছের কাছে বেঁচে থাকার জন্য যা চাওয়া হয়, তা–ই পাওয়া যায়। এ গাছ থেকে পাওয়া যায় রস, গুড়, চিনি, তালমিছরি, তালশাঁস, তাল ফল, তাল ফোঁপা, নারকেলের মতো বীজের শাঁস থেকে তেল ইত্যাদি খাদ্য। এমনকি তালের আঁটি থেকে সদ্য গজানো অঙ্কুর বা গ্যাঁজ সেদ্ধ করে খাওয়া যায়, যা পুষ্টিকর।
পাকা তালের আঁশ থেকে পাওয়া যায় রেয়নের মতো সুতা, যা দিয়ে তৈরি করা যায় বস্ত্র। বাসস্থান নির্মাণের জন্য তালকাঠের চেয়ে শক্ত কাঠ আর কি আছে! তালগাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যে যুগে কাগজ আবিষ্কৃত হয়নি, সে যুগে তালপাতা ব্যবহৃত হতো লেখার জন্য। এখনো অনেক জাদুঘরে তালপাতার পুঁথি দেখা যায়। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা—মানুষের এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদার সবই পূরণ করতে পারে তালগাছ। তালগাছের বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি কারুপণ্য, যেমন হাতপাখা, টুপি, ব্যাগ, বর্ষাতি, মাথাল, ঝুড়ি উপার্জনের উৎস। তালের রস আফ্রিকায় মদ ও বিয়ার তৈরির অন্যতম উপকরণ। একটি গাছ থেকে বছরে প্রায় ১৫০ লিটার রস পাওয়া যায়।
তাল ত্রিশ
তালের ব্যবহার শত শত। তাল শব্দটির ব্যবহার আছে বাংলার প্রবাদ প্রবচনেও। যেমন তালগাছের আড়াই হাত, তালকানা, তালপুকুর, তালপাতার সেপাই, তালগোল পাকানো ইত্যাদি। তালের রস থেকে তৈরি হয় গুড়, বাদামি চিনি, তালমিছরি, তাল পাটালি, তাড়ি, বিয়ার, মদ ইত্যাদি। পাকা তালের কমলা রস বা গোলা থেকে তৈরি হয় তালবড়া, তালপিঠা, তালক্ষীর, তাল পাটালি, তাল বরফি ইত্যাদি। তালের আঁটি থেকে হয় গ্যাঁজ বা অঙ্কুর, ফোঁপা, তাল সুপারি, তেল ইত্যাদি। গাছের গুঁড়ি থেকে বানানো হয় তালের ডোঙা, তালকাঠ। পাতা থেকে হয় হাতপাখা, ঘরের ছাউনি, টুপি, পাটি, হাতব্যাগ, বর্ষাতি বা ছাতা, মাথাল, তালপাতার বাঁশি ইত্যাদি।
প্রকৃতির আইন
প্রকৃতির একটা আইন রয়েছে। মাটির নিচে থাকা জল খাবে পৃথিবীতে যত গাছপালা আছে তারা। আর মাটির ওপরে নদ-নদী, পুকুর, দিঘি, ঝরনা ইত্যাদির জল ব্যবহার করবে মানুষ ও প্রাণীরা। আমরা এ আইন অমান্য করেছি, ভাগ বসিয়েছি গাছপালাদের জলে। তাই তালের মতো গাছেরাও এখন জলকষ্টে পড়েছে, খরা সহ্য করতে পারে ওরা। খনার বচনে ‘কুয়ো হয় আমের ভয়/ তাল তেঁতুলের কিবা ভয়!’ অর্থাৎ কুয়াশায় আমের মুকুল নষ্ট হয় কিন্তু তাল ও তেঁতুলের কিছুই হয় না। এটাও তালের প্রতি প্রকৃতির আশীর্বাদ। সে কারণেই হয়তো আজও তাল টিকে আছে বরেন্দ্রভূমির মতো খরাপীড়িত মাটিতেও ও শৈত্যপ্রবাহের দেশে।
বিভিন্ন কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তালগাছ কমে যাচ্ছে। যেমন ভারতের স্বাধীনতার আগে তামিলনাড়ুতে ৫০ কোটির বেশি তালগাছ ছিল, বর্তমানে আছে প্রায় পাঁচ কোটি। তালগাছ তামিলনাড়ুর রাজ্যবৃক্ষ। সেখানে তালগাছ দুটি আদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে—দেশাত্মবোধ ও অকপটতা। এই প্রতীক তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষায় আরও বেশি দায়িত্বশীল করেছে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার আগে যে পরিমাণ তালগাছ ছিল, এখন তা নেই। তালগাছ লাগানোর যেমন লোক নেই, তেমনি তালগাছে উঠে রস নামানো ও তাল পাড়ার লোকও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। তালগাছ কমে যাচ্ছে। দেশে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। এ জন্য সরকারিভাবে দেশে তালগাছ রোপণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তালগাছ রক্ষায় শ্রীলঙ্কায় আইন আছে। সে দেশে এই গাছ কাটা অজামিনযোগ্য অপরাধ।