গুয়াশার নবজাগরণ

চলমান অতিমারির লকডাউন স্কিনকেয়ার ট্রেন্ডে সবচেয়ে আলোচিত ফেস ও বডি স্কাল্পিং এবং কোয়েনিং পদ্ধতি হলো গুয়াশা। রুদ্ধবাসের সময় ঘর আর বাইরের কাজ একসঙ্গে ঘরে বসেই সামাল দিতে হচ্ছে বলে একটা কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। তার ওপর রয়েছে নানা কিছুর সঙ্গে আপস করা।

মিরান্ডা কার জেনডায়া, এমিলিয়া ক্লার্করা এখন গুয়াশার ফ্যান
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

কারণ, করোনাকালে অনেক পরিচর্যা রুটিন মানা সম্ভব হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে না অনেক কসমেটিক ট্রিটমেন্ট। এই সময়ে প্রাচীন কিছু চৈনিক পদ্ধতি বেশ আস্থা অর্জন করেছে। এরই একটি গুয়াশা। এটা আসলে ফেস ও বডি স্কাল্পিং এবং কোয়েনিং পদ্ধতি। এটা শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বব্যাপী বেশ সুনাম অর্জন করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হওয়া ইনফ্লুয়েন্সার ও সেলিব্রিটিদের স্কিন কেয়ার রুটিনে প্রাচীন এই স্ক্র্যাপিং পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ‘গেমস অব থ্রোনস’–এর জনপ্রিয় নায়িকা এমিলিয়া ক্লার্ক, ‘দ্য গ্রেটেস্ট শোম্যান’–এর জেনডায়া, ‘আয়রনম্যান’–এর গোয়েন্থ প্যালট্রো, কিম কারদাশিয়ান, কেন্ডাল জেনার, মেগান মার্কেল, টপ মডেল মিরান্ডা কারসহ অনেকেই এখন গুয়াশার অনুরাগী।

গুয়াশার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় প্রাচীন চাইনিজ মেডিসিনে। মিং রাজবংশের সময় (১৩৬৮-১৬৪৪) শরীরের নানা ধরনের রোগ সারানোর জন্য মূল্যবান পাথর, মহিষ বা ষাঁড়ের শিং দিয়ে হালকা ঘষা হতো। তারা বিশ্বাস করত, মানুষের দেহে ধনাত্মক শক্তি আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সাহায্য করে। এই শক্তি অবরুদ্ধ হওয়ার ফলে শরীরে প্রদাহ ও অসুস্থতা দেখা দেয়। ত্বকের ওপর হালকা ঘষে এ শক্তি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এশীয় লোকজন বিশ্বাস করত এর মাধ্যমে শরীরের মাংসপেশিতে, টিস্যু ও অন্ত্রে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং এটি ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়।

চাইনিজ শব্দ ‘গুয়া’ মানে আঁচড়ানো এবং ‘শা’র আক্ষরিক অর্থ হলো বালি। কিন্তু এখানে শরীরের লালচে ভাবকে বোঝানো হয়েছে। গুয়াশার টুলগুলো দিয়ে স্ক্র্যাপিং করার পর সেই সব স্থানের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের টক্সিনের কারণে বালির মতো লাল লাল ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অঞ্চল তৈরি করে, যা আবার সময়ের ব্যবধানে স্বাভাবিক হয়ে যায়। আলতো করে স্ক্র্যাপ করার কারণে ত্বকের নিচে ছোট ছোট বিন্দু বের হয়; ছোট ছোট কণিকা বালির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

গুয়াশা টুলস

পূর্ব এশিয়ার ঔষধি দিয়ে আরোগ্য লাভের জন্য প্রথমে মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হাতল ত্বকের ম্যাসাজ করায় ব্যবহার করা হতো। আধুনিক কালে উন্নত দামি পাথর ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন পাথর, বর্ণিল রং ও আলাদা আলাদা শেপের গুয়াশা টুল ত্বকের টক্সিন ও ক্লান্তি দূর করতে খুব উপকারী। সবচেয়ে জনপ্রিয় আরোগ্যময় পাথরগুলো হলো—
জেড স্টোন: এটি সবচেয়ে পরিচিত স্টোন। প্রাকৃতিক কুলিং স্টোন, যা ত্বকের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। কন্টুরিং, ফেস লিফটিংয়ের জন্যও বেশ সহায়ক।

নানা ধরনের গুয়াশা টুল
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

রোজ কোয়ার্টজ: প্রাকৃতিক প্রশান্তির এই জেমস্টোন সেনসেটিভ স্কিনের জন্য অনেক ভালো কাজ করে। বলা হয়ে থাকে হার্টশেপ কোয়ার্টজ এবং এই পাথরের রং হৃদয়ে ভালোবাসা ও প্রশান্তি নিয়ে আসে।

গ্রিন অ্যাভেনচুরাইন: এই পাথরকে সৌভাগ্যের প্রতীকও বলা হয়। এই কোয়ার্টজ মুখের বলিরেখা দূর করে উদ্দীপনা বাড়ায়।

বিয়ান স্টোন: এই পাথর হচ্ছে গুয়াশার জন্য খাঁটি ও প্রাচীনতম পাথর। চীনের সিবিন গ্রামে এর উৎপত্তি। সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রনিক পালসসমৃদ্ধ এই পাথর গভীরে প্রবেশ করে স্ট্রেস থেকে মুক্তি দেয়।

অ্যামেথিস্ট: বেগুনি রঙের আকর্ষণীয় এই পাথরের শীতল স্পর্শ চোয়াল ও টেম্পলের মাংসপেশি রিলাক্স করে।

ব্ল্যাক অবিসিডিয়ান: মূল্যবান এই পাথরের ম্যাসাজ নেগেটিভ চিন্তাভাবনা, ক্লান্তি ও ক্রোধ দূর করে। এর মধ্যে আত্মিক, আধ্যাত্মিক, প্রশান্তির নিদর্শন রয়েছে।

গুয়াশা ম্যাসাজিং

যেকোনো গুয়াশা টুল দিয়ে ম্যাসাজিং করার আগে সেই স্থান ভালো মতো পরিষ্কার করে নিতে হয়। তারপর কোনো ময়েশ্চারাইজার, লোশন বা তেল ব্যবহার করে নিতে হবে, এতে করে খুব আরামে স্টোনটি চালানো যায়।

মুখ: বলা হয়ে থাকে, সারা দিনের দেহের ধকলের মানচিত্র মুখেই ফুটে ওঠে। একটা ক্লান্তিমাখা দিন শেষে মুখের ত্বকের বিশেষ যত্ন নেওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। মুখ ফেসওয়াশ দিয়ে ভালো করে ধুয়ে তারপর সিরাম বা ফেসওয়েল লাগানোর পর ‘আপওয়ার্ড ও আউটওয়ার্ড’ নিয়মে গুয়াশা স্টোন ব্যবহার করতে হয়। প্রথমে কপাল থেকে আপওয়ার্ড, অর্থাৎ চুলের গোড়ার দিকে হালকা চাপ দিয়ে স্টোনটি নিয়ে যেতে হবে। অনেক স্টোনের একপ্রান্তে চিরুনি যুক্ত করা থাকে, ইচ্ছা অনুযায়ী চুলের গোড়ায় চালিয়েও আরাম পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে নাকের প্রান্ত থেকে কানের লতি পর্যন্ত আউটওয়ার্ড মোশনে হালকা ঘষতে হবে। এতে ফেস লিফট ও কন্টুর হয়। এবার পাথরের ঢেউ খেলানো প্রান্ত ব্যবহার করে চোয়ালের মাঝ থেকে কান পর্যন্ত চালাতে হবে, যা ডাবল চিন দূর করে। আবার একই প্রান্ত ব্যবহার করে চোখের ওপর ভ্রু লাইনে হালকা চাপ দিয়ে ঘষলে আরাম পাওয়া যায়।

ঘাড় ও কাঁধ: স্ট্রেস, ক্লান্তি আর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে ঘাড় ও কাঁধে গুয়াশা স্টোনের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই। কাঁধের মাঝ থেকে হালকা চাপ দিয়ে হাতের কাছাকাছি পর্যন্ত চালাতে হবে। আবার পেছনের দিকে চুলের গোড়া থেকে মেরুদণ্ড বরাবর ঘষে আরাম পাওয়া যায়। সাধারণত নামি স্পাগুলোয় বডি ম্যাসাজিং গুয়াশা টুলসগুলোই ব্যবহার করা হয়।

গুয়াশা স্টোনগুলো সব সময় তির্যকভাবে (৩৫-৪০ ডিগ্রি) ব্যবহার করতে হয়, খাড়াভাবে নয়। আর স্টোনগুলো ব্যবহারের আগে ৫-১০ মিনিট ফ্রিজিং করে নিলে ভালো হয়।

উপকারিতা

ছবি: পেকজেলসডটকম

• অ্যান্টি-অ্যাজিং এবং অ্যান্টি–রিংকেল এই ম্যাসাজ মুখের আকুপ্রেশার পয়েন্টগুলোকে সক্রিয় করে। ফলে পেশি দৃঢ় হয় এবং ডিটক্সিফাইং করে বিষাক্ত পদার্থগুলোকে বের করতে সাহায্য করে।

• যখন গুয়াশা ব্যবহার করা হয়, তখন সেই স্থান থেকে শরীরে রক্ত সঞ্চালনের জন্য নির্দেশ পাঠানো হয়। এতে করে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং অক্সিজেন পৌঁছায়। ত্বকে উজ্জ্বলতা নিয়ে আসে।

• লিম্ফটিক ড্রেনেজে সাহায্য করে চোখ ও মুখের ফোলা ভাব কমায়। ত্বক মসৃণ করে।

• ব্লকেজ রিলিজ করে টেনশন কমায়। শরীরের ক্ষতিকর চর্বি ও সেলুলাইট দূর করে।

• মাথা ও মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করতে খুবই সহায়ক। এমনকি যেকোনো পেশির ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে।

• প্রাচীনকাল থেকে ঠান্ডা, সর্দি, হিটস্ট্রোক, এমনকি সিজনাল অসুস্থতার জন্য বিশ্বাসযোগ্য।