বাংলাদেশ দরদি এই চিকিৎসক খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবনের অন্যতম গবেষক

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের শরণার্থীশিবিরে কলেরা-ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের নিরাময়ে কাজ করেছেন দিলীপ মহলানবিশ। পরে আইসিডিডিআরবিসহ বিশ্বখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই চিকিৎসক খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবনের অন্যতম । ১৬ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গে প্রয়াত হলেন। বাংলাদেশ দরদিকে শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর সাবেক সহকর্মী ও আইসিডিডিআরবির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক ডা. তাহমিদ আহমেদ

চিকিৎসক ও গবেষক দিলীপ মহলানবিশ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৫ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে জুনিয়র চিকিৎসক হিসেবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) যোগদান করি। প্রতিষ্ঠানটির ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক তখন দিলীপ মহলানবিশ। স্যারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শুরু হলো আমার কর্মজীবন। স্বল্পভাষী আর রাশভারী মানুষ ছিলেন তিনি। চিকিৎসা ও গবেষণার পাশাপাশি প্রশাসক হিসেবেও ছিলেন দারুণ দক্ষ। মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। রোগী ও রোগীর স্বজনদের প্রতি পোষণ করতেন শর্তহীন মমতা। এই বহুমুখী গুণের জন্যই বোধ হয় খুব অল্প সময়ে মানুষটি আমার হৃদয়ে  উচ্চাসনে আসীন হলেন। আরেকটা ব্যাপারও আছে অবশ্য। স্যারের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ আর আমার ময়মনসিংহ। একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় একধরনের সূক্ষ্ম গর্বও বোধ করতাম। স্যারের প্রতি বিশেষ অনুরাগ সৃষ্টিতে এই ব্যাপার কিছুটা হলেও কাজ করে থাকতে পারে।

অত্যন্ত দূরদর্শী মানুষ ছিলেন দিলীপ স্যার। অভিজ্ঞতায় পূর্ণ একটি জীবন। তাঁর ভেতর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করত। তা হলো, মানুষ তৈরি করা—অর্থাৎ মানবসম্পদ সৃষ্টি। সে সময় আইসিডিডিআরবিতে যত তরুণ চিকিৎসক, গবেষক ছিলেন, তাঁদের সবাইকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। যে যে কাজের যোগ্য, তাঁকে সেই অনুযায়ী গড়ে তুলতেন। পরবর্তীকালে যার ফল পাওয়া গেছে। তাঁর হাত ধরে তৈরি হয়েছেন অনেক চিকিৎসক, গবেষক। উচ্চশিক্ষার জন্য একবার আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে নির্বাচিত হলাম। সেখানে যাওয়ার তোড়জোড় করছি, এমন সময় একদিন স্যার ডাকলেন। বললেন, ‘সবাই তো ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছে। তোমাকে নিয়ে আমি অন্য রকম ভাবছি। জাপান থেকে একটি বৃত্তি এসেছে। আমি চাই, তুমি সেখানে যাও।’ আমি জাপানেই গেলাম।

শুধু আমাকে নয়, এ রকম আরও অনেক শিক্ষার্থীকে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। উন্নত দেশের সহায়তায় আমাদের দেশে চিকিৎসাবিষয়ক সেমিনার, নানা রকম ট্রেনিংসহ কত কিছুর আয়োজন করেছেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও ভালো করা যায় কী করে, সেই ভাবনা ভেবেছেন।

আজ আমি আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। তাঁর গড়ে দেওয়া ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে, তাঁর বাতলে দেওয়া পথ পাড়ি দিয়ে এতটা দূর এলাম। অনেক দিন ধরে স্যারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। তবে খোঁজখবর রাখতাম। পাঁচ-ছয় বছর আগে আইসিডিডিআরবিতে একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে স্যারকে নিয়ে এসেছিলাম। তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেটিই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা।

বাংলাদেশের সন্তান, জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে, দেশভাগের ডামাডোলে কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যত্ন করে রেখেছিলেন জননী জন্মভূমিকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বনগাঁ সীমান্তের শরণার্থীশিবিরে ভয়াবহ কলেরা দেখা দেয়। দিলীপ মহলানবিশ তখন কলকাতায়। একজন হৃদয়বান চিকিৎসক হিসেবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায় অনুভব করলেন। ছুটে গেলেন বনগাঁ। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ছিল না, ছিল না প্রয়োজনীয় ওষুধ–পথ্য। কেবল খাওয়ার স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন হাজার হাজার মানুষ। পরে এর ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করলেন একটি গবেষণা প্রবন্ধ,  যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চাঁদপুরের মতলবে এর আগেই অবশ্য খাওয়ার স্যালাইনের সবচেয়ে বড় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি হয়ে গেছে। পরিণতিতে খুব দ্রুতই বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায় খাওয়ার স্যালাইন।     

জীবদ্দশায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি দিলীপ মহলানবিশ। এটি আমাকে বেদনাহত করে। যুদ্ধকালে অনেক অসহায় প্রাণ বাঁচানো চিকিৎসক, কর্মজীবনে বহু সফল চিকিৎসক তৈরির কারিগর এভাবে আড়ালে রয়ে যাবেন! বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্যারকে মরণোত্তর কোনো স্বীকৃতি দেওয়া গেলে খুবই ভালো হয়। এসব মানুষকে তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদেরই পৌঁছে দিতে হবে। (অনুলিখিত)