জেলেপল্লির শিশুদের নিয়ে কাজ করে সুস্মিতার অর্জন

সুস্মিতা পেয়েছেন ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

পড়াশোনার পাশাপাশি বরাবর সামাজিক কাজে অংশ নেওয়ার আগ্রহ সুস্মিতা অধিকারীর। ভালো কাজ করার ব্যাপারে শিক্ষক ও বাবা-মায়ের উৎসাহ পেয়েছেন সব সময়। সেই আগ্রহ থেকেই যুক্ত হন পিরোজপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে। সংগঠনটি জেলে জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে। করোনার সময়ে নিজেকে এই কাজে পুরোপুরি ব্যস্ত রেখে সুস্মিতা পেয়েছেন ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২২।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বড় শিংগা গ্রামের শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র অধিকারীর মেয়ে সুস্মিতা অধিকারী। পড়াশোনা করছেন ঢাকার বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে সম্মান চতুর্থ বর্ষে। দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সুস্মিতা অধিকারী ফিরে যান বাড়িতে। হাতে অফুরন্ত সময়। তাই স্থানীয় কোনো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার উপায় খুঁজতে শুরু করেন সুস্মিতা। সেভাবেই যুক্ত হন হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে। ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ তড়িৎ প্রকৌশলী মো. রুবেল মিয়া কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল, মঠবাড়িয়া উপজেলার বলেশ্বর নদ-তীরবর্তী গ্রামগুলোর জেলেপল্লির শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলা। বিশেষ করে দরিদ্র শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধে কাজ করে সংগঠনটি। গত চার বছরে শতাধিক শিশুকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন। সংগঠনের ফ্রাইডে স্কুলে বিদ্যালয় থেকে দেওয়া পড়া বুঝিয়ে দেওয়া হয় শিশুদের। জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুদের কল্যাণে কাজ করে সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন ২০২০ সালে অর্জন করে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড।

হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুমন চন্দ্র মিস্ত্রি বলেন, ২৫৬টি সংগঠনের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে এবার ১৫ জন নারীকে ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। সেখানে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন সুস্মিতা অধিকারী। ইউএনভি বাংলাদেশ, ভিএসও বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এবং একশনএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ২২ আগস্ট রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এলজিইডি ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় সুস্মিতার হাতে।

জেলেপল্লির শিশুদের জন্য আয়োজন করা হয় আনন্দ অনুষ্ঠান
ছবি: সংগৃহীত

হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের বর্তমানে সহসভাপতির পদে আছেন সুস্মিতা অধিকারী। ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ডের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এক লাখ টাকার পুরোটাই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করার আগ্রহ তাঁর। এ জন্য একটি তহবিল গঠন করার ইচ্ছা সুস্মিতার। শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে এই তরুণীর। আর তাই সেসব দিকে বিশেষ নজর দিতে চান তিনি। সুস্মিতা অধিকারী বলেন, ‘জেলেপল্লিতে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষই জেলে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না । কিশোর বয়সে শিশুরা পড়াশোনা ছেড়ে বড়দের সঙ্গে জেলেনৌকায় নদীতে মাছ ধরতে যায়। অজ্ঞতা ও অভাবের কারণে প্রতিবছর অনেক শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরেও পড়ে। আমরা সেসব বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের সন্তানদের কেন পড়াশোনা করানো জরুরি, সেটা বুঝিয়ে স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা করি।’

সুস্মিতা যোগ করেন, এসব শিশুকে নিয়ে কাজ করতে গিয়েই বুঝেছি, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ পাঠ্যবই পড়তে পড়তে একসময় একঘেয়েমি আসাই স্বাভাবিক। সেখান থেকে শিশুরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এসব দিক বিবেচনা করে গড়ে তোলা হয়েছে উপকূল পাঠাগার। যেখানে শিশুরা পরিচিত হচ্ছে ল্যাপটপ, ট্যাব, প্রজেক্টরের মতো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে।

শিশুদের জন্য আরও নানা রকম প্রকল্প আছে সুস্মিতাদের হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের। এর মধ্যে একটি প্রকল্প ‘স্বপ্নপূরণ’। বর্ষা মৌসুমে শিশুরা যাতে বিদ্যালয়ে যেতে পারে, সে জন্য দেড় শতাধিক শিশুকে রঙিন ছাতা উপহার দেওয়া হয়েছে স্বপ্নপূরণ প্রকল্পের মাধ্যমে। শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম বাড়াতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখানো হয়। আর এসব কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন সুস্মিতা অধিকারী।

সুস্মিতা বলেন, ‘করোনা মহামারির সময়ে শিশুদের জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে ওঠে। বিদ্যালয় অনেকদিন বন্ধ থাকার সময়ে আমরা শিশুদের খোঁজখবর রেখেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলে পরিবারের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার আয়োজন করেছি। ফল উৎসব করেছি।’

নিজের পড়াশোনার কারণে সুস্মিতা বর্তমানে ঢাকায় আছেন। তবে সুযোগ পেলেই ছুটে যান পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। জেলেপল্লির শিশুদের নিয়ে দিন কেটে যায় আনন্দেই। স্বপ্ন দেখেন, জেলেপল্লির শিশুরা একদিন শতভাগ পড়াশোনায় আগ্রহী হবে। মাছ ধরার নৌকা ছেড়ে সুনাম বয়ে আনবে পরিবার ছাড়িয়ে দেশের জন্য।