দেশের অন্যতম বৃহত্তম ঈদ জামাতের মাঠ দিনাজপুরের গোর–এ–শহীদের নামকরণের ইতিহাস

দীর্ঘদিন ধরেই দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতটি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে হয়ে আসছে। এই মাঠে নামাজ পড়তে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন মুসল্লিরা। তবে কয়েক বছর ধরে শোলাকিয়ার পাশাপাশি নতুন একটি নামও শোনা যাচ্ছে, সেটা গোর–এ–শহীদ মাঠ। দেশভাগের পর থেকে দিনাজপুরের এই মাঠে ঈদের জামাত হচ্ছে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই ঈদ জামাতের মাঠ নিয়ে লিখেছেন রাজিউল ইসলাম

গোর–এ–শহীদ মাঠ নিয়ে দুটি জনশ্রুতি চালু আছে। একটিতে বলা হয়েছে, পারস্য থেকে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে মারা যান শাহ আমিরউদ্দিন ঘুরি (রহ.)। মাঠের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেই থেকে এই মাঠের নাম গোর-এ-শহীদ মাঠ। অন্য একটি জনশ্রুতিতে জানা যায়, সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর আমলে ৪০ জন সুফিযোদ্ধার সঙ্গে তৎকালীন রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। সুফিদেরই একজন বর্তমান বড় মাঠে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল। ফারসিতে ‘গোর’ অর্থ  কবর।  মাঠটিও তাই পরিচিতি পায় গোর-এ-শহীদ মাঠ।

দেশভাগের পর থেকে দিনাজপুরের গোর–এ–শহীদ মাঠে ঈদের জামাত হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঐতিহাসিক গোর-এ-শহীদ মাঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উত্তর ফ্রন্টের সমাবেশ হয়েছিল। পরেও মাঠটি সেনাবাহিনীর নামেই রেকর্ড হয়। সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠটির আয়তন ২২ একর। খেলাধুলা থেকে শুরু করে আড্ডা, বিভিন্ন মেলা, জাতীয় দিবস, এমনকি গণসংবর্ধনার আয়োজনও করা হয় এই মাঠে। স্থানীয় লোকজনের কাছে মাঠটি ‘লিভার অব দিনাজপুর’।

স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই এই মাঠে ঈদের জামাত হয়ে আসছে। তবে মাঠটিতে তখন বড় কোনো মিম্বর ছিল না। ২০১৫ সালে বড় পরিসরে এখানে একটি ঈদগাহ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ। দুই বছর পর ২০১৭ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। মিনারটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। আয়োজকদের দাবি, সেই বছর এই মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন ৬ লাখের বেশি মুসল্লি। ইমামতি করেন মাওলানা শামসুল হক কাসেমী। এর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি পায় গোর-এ-শহীদ মাঠ। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা।

প্রতি ঈদে এখানে লাখ লাখ মানুষ ঈদের নামাজে অংশ নেন
ছবি: প্রথম আলো

মিনার তৈরির পর থেকেই গোর-এ-শহীদ মাঠের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়েছে কয়েক গুণ। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি মিনারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন পর্যটকেরাও। মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাবন্দী করেন সুন্দর সব মুহূর্ত। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে লাল–খয়েরি আর সাদা রঙের ৫১৬ ফুট দীর্ঘ ঈদগাহ মিনারটি নজর কাড়ে। ৫২ গম্বুজবিশিষ্ট ঈদগাহ মিনারটি মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। দুই প্রান্তে দুটি মিনারের উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝের দুটির উচ্চতা ৫০ ফুট আর টাইলস করা মিহরাবের উচ্চতা ৫৫ ফুট। এতে খিলান আছে ৩২টি। প্রতিটি গম্বুজে আছে বৈদ্যুতিক বাতি। সন্ধ্যার পরপরই মিনারে জ্বলে ওঠে আলো।

প্রতি ঈদে এখানে লাখ লাখ মানুষ ঈদের নামাজে অংশ নেন। দূরদূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের জন্য বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয় প্রতিবছর। ঈদের আগে কয়েক দিন ধরে সংস্কার ও ধোয়ামোছার কাজ করেন কয়েক শ শ্রমিক। বিশেষ আলোকসজ্জা করা হয় ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে। ২০টির মতো প্রবেশপথ এবং কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়। মুসল্লিদের জন্য গাড়ি পার্কিং, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থায় থাকেন।

মাঠের পশ্চিম প্রান্তে লাল–খয়েরি আর সাদা রঙের ৫১৬ ফুট দীর্ঘ ঈদগাহ মিনারটি নজর কাড়ে
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের নামাজে আসা মুসল্লিদের সংখ্যা গণনার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা এবার রাখা যায় কি না, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যবস্থা করা গেলেই কেবল নিশ্চিত হওয়া যাবে, গোর–এ–শহীদ মাঠের ঈদের জামাতে কত মানুষ অংশ নেন।

আরও পড়ুন