ছেলের জন্য স্কুল খুঁজে না পেয়ে নিজেই স্কুল খোলেন সুবর্ণা

সুবর্ণা ও ছেলে অরিজিৎ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কদিন আগেও মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ করত ছেলে, ডাকলে সাড়া দিত, কিন্তু বয়স তিন হতেই কী যেন হলো! হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল অরিজিৎ। সন্তানের এই পরিবর্তন মাকে ভাবিয়ে তুলল। শিশু নাক-কান-গলাবিশেষজ্ঞসহ ঢাকার বিভিন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেন সুবর্ণা চাকমা। এক প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হলো, শব্দ শোনার ক্ষেত্রে অরিজিতের প্রবল সমস্যা আছে।

কথাটা সুবর্ণার বিশ্বাস হলো না। কারণ, তখনো টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপন হলে ছুটে আসে ছেলে, আরও কিছু শব্দে সাড়া দেয়। সংশয় নিয়ে চলে গেলেন ভারতে। কলকাতার চিকিৎসকেরা দেখে জানালেন, শব্দ শোনার ক্ষেত্রে শিশুটির সমস্যা নেই।

তাহলে সমস্যা কী? কলকাতার চিকিৎসকেরাও সুনির্দিষ্ট কোনো সুরাহা দিতে পারলেন না।

নিজের প্রতিষ্ঠানে সুবর্ণা চাকমা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ডে–কেয়ারও রাখল না

এসবই ১৯৯৩ সালের ঘটনা। রাঙামাটির সুবর্ণা চাকমা তখন ঢাকায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চাকরি করেন। তাঁর স্বামী মিহিরকিরণ চাকমাও চাকরিজীবী। দুজনেরই কর্মব্যস্ত জীবন। তাহলে অরিজিৎকে সামলাবে কে? একটা দিবাযত্ন কেন্দ্রে (ডে–কেয়ার সেন্টার) রাখার ব্যবস্থা হলো। সকালে সেখানে রেখে অফিসে চলে যেতেন সুবর্ণা। কিন্তু কদিন যেতেই জানানো হলো, অরিজিৎ কান্নাকাটি করে। একা একা থাকে, অন্য শিশুদের সঙ্গে কথা বলে না।

একসময় অন্য অভিভাবকেরা অভিযোগ দেওয়া শুরু করলেন, তাঁদের সন্তানের সঙ্গে অরিজিৎকে রাখা যাবে না। শেষ পর্যন্ত অরিজিৎকে আর ডে–কেয়ারে রাখা গেল না। এর মধ্যে ঢাকার এক নিউরো–বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গেলেন তাঁরা। সিঙ্গাপুরের বিশেষায়িত এই হাসপাতাল থেকেই জানানো হলো, অরিজিৎ অটিস্টিক শিশু। ওর বিকাশে বিশেষ যত্ন দরকার। আর দরকার বিশেষ স্কুল।

মা ও বাবার সঙ্গে অরিজিৎ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ডাক্তারি পরামর্শ মেনে অরিজিৎকে লালমাটিয়ার একটি বিশেষ স্কুলে ভর্তি করা হলো। একপর্যায়ে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। দিশাহারা সুবর্ণা তাঁর মতো আরও কয়েকজন মায়ের সঙ্গে আলাপ করলেন। নিজেরাই স্কুল চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এভাবেই ২০০০ সালে সুবর্ণারা পাঁচজন মিলে গড়ে তুললেন সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন (সোয়াক)। সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক রেখে ছয় শিশুকে নিয়ে শুরু হলো কার্যক্রম।

আমার কোনো হীনম্মন্যতা নেই

‘আমাদের দেশে কোনো পরিবারে এ ধরনের শিশু থাকলে তাদের কী অবস্থা হয়, শুধু তারাই জানে। অনেকেই ছেলেকে নিয়ে বাইরে যেতে নিষেধ করত। আমরা কোনো দিন তা শুনিনি। সব সময় ওকে সঙ্গে রেখেছি। যেখানে গেছি, ওকে নিয়ে গেছি। কে কী বলল, সে বিষয়ে মাথা ঘামাইনি। আমার সন্তান অটিস্টিক, এটা নিয়ে আমার কোনো হীনম্মন্যতা নেই। এটাকে বাস্তবতা বলে মানি,’ ছেলেকে নিয়ে লড়াইয়ের গল্প বলছিলেন সুবর্ণা চাকমা।

ছেলেকে নিয়ে পদে পদে আরও কত অভিজ্ঞতা, ‘যখন ব্যাংকে চাকরি করতাম, স্বাভাবিক অফিসের পোশাকে মোটামুটি সেজেই যেতাম। অনেকেই বলত, ছেলেটা এমন তারপরও সেজে আসে। ব্যাপারটা এমন যে আমার ছেলে অটিস্টিক তাই সব সময় কাঁদব, আলুথালু বেশে থাকব। এটা কেন? কষ্ট তো আমার, আমিই করছি। সবাইকে সেটা বলে বেড়ানো বা দেখানোর তো মানে হয় না।’

দিশাহারা সুবর্ণা তাঁর মতো আরও কয়েকজন মায়ের সঙ্গে আলাপ করলেন। নিজেরাই স্কুল চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

পাঁচতলা ভবনে সোয়াক

অরিজিতের পর সুবর্ণার দুই মেয়ে হয়েছে। তাঁদের প্রতিষ্ঠান ‘সোয়াক’ও অনেক ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে গেছে। ২০১৬ সাল থেকে চাকরি ছেড়ে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন সুবর্ণা।

রাজধানীর আদাবরে পাঁচতলা একটি ভবনে এখন সোয়াকের কর্মকাণ্ড চলছে। সেখানে ৮৫ অটিস্টিক শিশু-কিশোর আছে। শিশু থেকে বয়স্ক—সব বয়সীর জন্যই ব্যবস্থা আছে। ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য আছে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ঈদ, নববর্ষ বা বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের হাতে গড়া নানা সামগ্রী নিয়ে প্রদর্শনীও হয়। সেখানে অরিজিতের শিল্পকর্মও থাকে। অরিজিতের আঁকা একটি ছবি প্রধানমন্ত্রীর নববর্ষের কার্ডেও ব্যবহার হয়েছে। আঁকিয়ে হিসেবে এ জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন এক লাখ টাকা।

ঢাকায় এসেও কিন্তু পাহাড়ের মানুষকে ভুলে যাননি সুবর্ণা চাকমা। রাঙামাটি শহরে শ্বশুরবাড়িতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘সেন্টার ফর ইন্সপিরেশন’ নামে দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ২০টি শিশু আছে। রাঙামাটির

আরেক প্রতিষ্ঠান মনোঘরের সহযোগিতায় একটুকরা জমিতে গড়ে উঠছে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ভবন। সাভারের কবিরপুরে সোয়াকেরও স্থায়ী জমির বন্দোবস্ত হচ্ছে।

সুবর্ণা বলছিলেন, ‘আমি একা নই, সবার সহযোগিতা নিয়েই সোয়াকের অগ্রযাত্রা। কারও অবদান কম নয়। অনেক বাধা এসেছে। কিন্তু থামিনি। আমৃত্যু কাজ চালিয়ে যাব।’