সিএসই নিয়ে ১০ প্রশ্নের উত্তর

কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বা কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘সিএসই’। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। অনেকেই এ বিষয় নিয়ে পড়তে চান। তাই এ–সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমরা হাজির হয়েছিলাম কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়েছেন, এমন গবেষক, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের কাছে।

ছবি: অ্যাপল

১. সিএসই পড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ আছে

শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই চাকরির নানা ধরনের সুযোগ আছে। তা ছাড়া দক্ষতার ওপর নির্ভর করে অন্যান্য খাতেও কাজ করা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন সিএসইতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট শিকাগো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সিএসই পড়ে আপনি যেমন প্রোগ্রামার হতে পারেন, তেমনি এমবিএ করে যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন কাজ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা দায়িত্বে কাজের সুযোগ নিতে পারেন। শুধু কম্পিউটারবিজ্ঞান–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করতে হয়, বিষয়টি এমন নয়। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি এখন প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।’ এখন অনেক সিএসই গ্র্যাজুয়েট আছেন, যাঁরা ব্যাংকে কাজ করছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করছেন, টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার দিকেও সিএসই স্নাতকদের ঝোঁক চোখে পড়ে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়েছেন সুমন মোল্লা। এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইমকাস্টের সিনিয়র সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন, থাকেন নেদারল্যান্ডসের পুরমেরেন্ডে। তিনি বলেন, জনপ্রিয় যেসব ভূমিকায় চাকরি করা সম্ভব, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সফটওয়্যার প্রকৌশলী, ওয়েব ডিজাইনার ও ডেভেলপার, ডেটাবেজে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার, ডেভঅপস ইঞ্জিনিয়ার, এসকিউএ ইঞ্জিনিয়ার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, আইটি কনসালট্যান্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট, ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনার ইত্যাদি। এ ছাড়া নতুন নতুন অনেক চাকরির সুযোগ প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

২. কাদের সিএসই পড়া উচিত হবে না

সিএসই একটি সৃজনশীল খাত। তাই এ খাতে সফল হতে গেলে সংশ্লিষ্ট কাজের দক্ষতা থাকতে হয়। শুধু ডিগ্রি বা সনদ দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। ভালো কিছু করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে এবং ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। সারা জীবন নতুন কিছু শেখার মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি বা ধারণার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যা বোঝা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা করার মানসিকতা ও সক্ষমতা থাকতে হবে।

৩. সিএসইর ছাত্রের কি বাসায় কম্পিউটার থাকতেই হবে

তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে হাতে–কলমে পড়ালেখাই সিএসইতে বেশি। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোফিয়া নুর বলেন, বাসায় কম্পিউটার থাকলে ভালো হয়। কারণ, ব্যবহারিক অনেক কিছুই শেখার সুযোগ আছে। প্রোগ্রামিং বা কোডিংয়ের মতো বিষয়গুলো শিখতে প্রচুর চর্চা করতে হয়। সে জন্য নিজস্ব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকা ভালো। সিএসইর শিক্ষার্থীদের অনেক ইন্টার্নশিপ বা পার্টটাইম কাজের সুযোগ থাকে। এখন অনেক কাজ রিমোটলি, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে না গিয়েই করতে হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ যেহেতু আছে, তাই নিজের কম্পিউটার থাকা ভালো।

৪. অ্যানিমেশন, ভার্চ্যুয়াল গেমস, পোস্টার ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইনের মতো সৃজনশীল কাজে আগ্রহ আছে। সিএসই পড়লে কী সুবিধা হবে

সৃজনশীল কাজে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁদের জন্য সিএসই অনেক বড় একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়। অ্যানিমেশন, বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের মতো সৃজনশীল কাজ করতে সিএসই বা যেকোনো বিষয়েই পড়া যেতে পারে। যাঁরা সমস্যা সমাধান করতে ভালোবাসেন, দীর্ঘক্ষণ জটিল কোনো বিষয়ে ডুবে থাকতে আনন্দ পান, সিএসই পড়লে তাঁদের এ ধরনের চর্চা করার সুযোগ হবে।

৫. সিএসই পড়লে কি প্রোগ্রামিং করতেই হবে

প্রোগ্রামিং ছাড়াও সিএসইতে আরও বিভিন্ন ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে। সফটওয়্যার প্রকৌশলী সুমন মোল্লা বলেন, ‘প্রোগ্রামিং খুব ভালো না করেও কিছু কিছু কাজ করা সম্ভব। তবে সিএসইর আসল মজাই হচ্ছে প্রোগ্রামিং। আমার মতে, কেউ সিএসইতে পড়লে প্রোগ্রামিং, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, নেটওয়ার্কিং ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেসিক জিনিসগুলো তাঁর ভালোমতো জানা উচিত। তারপর নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো পদ বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যেতে পারে।’ ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, প্রোগ্রামিং জানা থাকলে সেটি শুধু সিএসই নয়, অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদেরও কাজে আসছে। আগামী দিনের ক্যারিয়ার বিবেচনায় সবাইকে এখন কিছু না কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা জানতে হচ্ছে। সিএসই পড়লে যে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে অতি অবশ্যই গভীর আর ব্যাপক ধারণা রাখতে হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। তবে প্রোগ্রামিংয়ের প্রাথমিক ধারণা এবং সমস্যা সমাধানের মানসিকতা থাকতে হবে। সিএসই–সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি অর্জন করতে গেলে প্রোগ্রামিং–বিষয়ক কিছু কোর্স স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে করতে হয়।

৬. স্কুল বা কলেজজীবন থেকে যদি প্রোগ্রামিং করি, তাহলে কি এগিয়ে থাকব

আগে প্রোগ্রামিং জানা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের কোর্সগুলোতে বেশ সুবিধা হয়। একদিকে যেমন নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন, তেমনি পুরোনো বিষয়গুলো ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। প্রোগ্রামিং বা কোডিং চর্চার বিষয়, সমস্যা সমাধানের কৌশল আয়ত্তের বিষয়। এখানে যে কেউ চর্চার মাধ্যমে কাজে দক্ষ হন এবং অনেক কিছু শেখার সুযোগ পান। তবে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের আগে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে জানার সুযোগ পাননি, তাঁদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের কোর্সগুলো এমনভাবে সাজানো হয়, যার মাধ্যমে আপনি প্রোগ্রামিং শিখতে পারবেন।

৭. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিএসই পড়ার খরচ কেমন

বাংলাদেশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি একেক রকম। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চার বছর মেয়াদি প্রোগ্রামের খরচ ৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অন্যদিকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইন সিএসই পড়তে খরচ হবে আট লাখ টাকার বেশি। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সিএসই পড়তে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে খরচ ৯ লাখ টাকার বেশি। তবে এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ওপর নির্ভর করে নানা ধরনের বৃত্তির সুযোগ আছে।

৮. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই পড়ে কি ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব

সিএসইর মজা হলো, এ খাতে সবার প্রথমে গুরুত্ব পায় দক্ষতা। তাই যেকোনো জায়গা থেকে পড়েই ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। সফটওয়্যার প্রকৌশলী সুমন মোল্লা বলেন, অনেকে স্নাতক শেষ করার আগেই ভালো চাকরি পেয়ে যান। মাথায় রাখতে হবে, দিন শেষে সফলতা নির্ভর করবে নিজের পরিশ্রম, যোগ্যতা ও চেষ্টার ওপর। তবে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনার সুযোগ পেলে সেটা একটা বাড়তি পাওয়া।

৯. দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন

বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই–সংক্রান্ত গবেষণায় বেশ ভালো অঙ্কের তহবিল বরাদ্দ থাকে। ড. বি এম মইনুল হোসেন জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিএসই বিষয়ে পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের হার বাড়ছে। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সিএসই–সংশ্লিষ্ট কোর্স পড়ার হারও অনেক বেশি। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, দেশে পড়া সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রযুক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগও আছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই নিয়ে পড়তে বৃত্তি ও আর্থিক অনুদানের খোঁজ মিলবে এ ওয়েবসাইট থেকে।

১০. সিএসই পড়তে হলে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে কোন বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে

যাঁরা ভবিষ্যতে সিএসই পড়বেন, তাঁদের গণিতের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান পড়তে পারলেও ভবিষ্যতে বেশ কাজে দেবে। গাণিতিক দক্ষতা ও বিশ্লেষণ নিয়ে আমাদের কোনো বিশেষ পাঠ্যক্রম নেই, কিন্তু কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এ কৌশল আয়ত্ত করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া গণিত অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডসহ কলেজ পর্যায়ের বিভিন্ন অলিম্পিয়াড ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কৌশল ও মনন বিকাশের সুযোগ আছে।