বিশ্বসেরা প্রকৌশলীদের তালিকায় বাংলাদেশের ড. তাহের
ধরুন, আপনার রক্তনালিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রোবট। এই জৈব রোবটের কাজই হলো শিরা-ধমনি ঘুরে ঘুরে ক্যানসারসহ নানা রোগের ক্ষতিকর কোষ খুঁজে খুঁজে ধ্বংস করা।
এমনই চমকপ্রদ এক গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাদে বিরল এক সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্নাতক, ঢাকার সন্তান অধ্যাপক তাহের এ সাইফ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (এনএই) সদস্যপদ পেয়েছেন তিনি। দেশটির ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আর্বানা-শ্যাম্পেইনে প্রায় ২৫ বছর ধরে জৈব রোবট নিয়ে গবেষণা করছেন এই অধ্যাপক।
বলা হয়, ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্যপদ প্রকৌশল খাতের সর্বোচ্চ সম্মাননাগুলোর একটি। যাঁরা প্রকৌশলসংক্রান্ত গবেষণা, শিক্ষা ও চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কিংবা যাঁদের গবেষণা প্রযুক্তি খাতে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হয়, তাঁরাই এই সম্মাননা পান।
এনএইর প্রেসিডেন্ট জন এল এন্ডারসন ৬ ফেব্রুয়ারি নবনির্বাচিত ১১৪ প্রকৌশলীর নাম ঘোষণা করেন। এ ছাড়া এ বছর আন্তর্জাতিক সদস্যপদ পেয়েছেন ২১ জন। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩১০ প্রকৌশলী ও গবেষক এনএইর সদস্য হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সদস্যপদ পেয়েছেন সব মিলিয়ে ৩৩২ জন।
২০১৬ সালে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় অধ্যাপক তাহেরকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ড. তাহেরের জীবন্ত রোবট বিপ্লব’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদন লিখেছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক। অধ্যাপক তাহেরের গবেষণাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা ছিল সেই প্রতিবেদনে—‘স্টেমসেল থেকে নেওয়া নিউরন আর পেশিকোষের সমন্বয়ে তৈরি হয় জৈব রোবট। নিউরনগুলোকে এই রকম দীক্ষা দেওয়া হবে যে তারা নিজে নিজেই সংকেত পাবে, কোথায় তাদের যেতে হবে। ধরা যাক, ক্যানসার সেলে চলে যাবে এই রোবট, নিউরনের নির্দেশে। সেখানে প্রতিষেধক উৎপাদনকারী কিছু কোষ নিজে নিজেই ক্যানসার সেলকে ধ্বংস করার উপাদান নিঃসরণ করবে। তাহলে আর বাইরে থেকে ক্যানসারের কোনো ওষুধই দিতে হবে না। এই রকম আরও অনেক রোগের বেলায়ও বাইরের কোনো রাসায়নিক ওষুধই দেওয়ার দরকার পড়বে না। সেটা ঘটলে ঘটে যাবে সত্যিকারের বিপ্লব। চিকিৎসাবিজ্ঞান যাবে পাল্টে।’
তাহের এ সাইফের এই অর্জনের খবর ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মেকানিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান টনি জ্যাকবি বলেছেন, ‘আমি খুবই খুশি যে আমার বন্ধু ও সহকর্মী এই সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অর্জন তার প্রাপ্য ছিল। খবরটা শুনে আমি এতই উৎফুল্ল হয়েছি যে আমার অফিসে নাচতে শুরু করেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেমন তাহেরের অর্জনে খুশি, তেমন এ কারণেও খুশি যে এটি আমাদের বিভাগের জন্যও বড় অর্জন।’
ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওয়েবসাইটে বলা আছে, আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এনএই-এর বার্ষিক সভায় নতুন সদস্যদের বরণ করে নেওয়া হবে।
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক তাহের যা বললেন
শেষবার যখন আপনার সঙ্গে কথা হয়, তখন আমরা বায়োবট নিয়ে আলাপ করেছিলাম। কেমন চলছে সেই কার্যক্রম?
এখন আমরা নিউরনের বায়োবট নিয়েও কাজ করতে শুরু করেছি। এই বায়োবট নিউরনের মতোই আমাদের পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এমনকি এর মধ্যে বুদ্ধিমত্তা বা একধরনের বোধ থাকার সম্ভাবনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কী উপদেশ দেবেন?
নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। বড় লক্ষ্য অর্জনের স্বপ্ন দেখো। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে কঠোর পরিশ্রম করে যাও। যদি সত্যিই কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে চাও, পৃথিবী কোনো না কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করবে। ছোটদের পরামর্শ দাও, বড়দের নির্দেশনা নাও। একে অপরকে সাহায্য করো।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আপনার পরামর্শ কী হবে?
বিশ্লেষণী চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করুন, পুরস্কৃত করুন। একটু অন্য রকমভাবে ভাবার সুযোগ দিন। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সবাইকে সম্মান করুন। শিক্ষার্থীরা যেন সাহসী সব আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে, সে জন্য তাদের উৎসাহ দিন।
এত বড় সম্মাননা পেয়ে আপনার কেমন লাগছে?
আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আমার শিক্ষার্থী ও যাঁরা আমার অধীন প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন, এই কৃতিত্ব আসলে তাঁদেরই প্রাপ্য। আমাকে যাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, আমার শিক্ষক, বন্ধু, স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী—যাঁরা সহায়তা করেছেন, ভালোবেসেছেন, এই কৃতিত্ব তাঁদের সবার।