মায়ের হাতের মাখা ভাতের মতোই মায়ের হাতের রান্নাতেও জাদু আছে
বিচিত্রায় একসময় নিয়মিত রেসিপি দিতেন আনোয়ারা তরফদার। তাঁর সেসব রেসিপি নিয়ে ১৯৮৯ সালে একটা বইও বের হয়েছিল। সেই বইয়েরই দ্বিতীয় মুদ্রণ উপলক্ষে আনোয়ারা তরফদারের রান্নার গল্প শোনালেন তাঁর মেয়ে কবি শামীম আজাদ
গল্পটা আধা শতাব্দী পুরোনো। সদ্যই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। মুখে রুচি নেই বলে না খেতে খেতে এমন অশক্ত হয়ে পড়ছি যে দাঁড়াতে গেলেও অবলম্বন লাগে। এ অবস্থায় শুধু আমিই না, আমার দেহ নিংড়ে রসদ নিয়ে যে বড় হওয়ার চেষ্টা করছে, তার জীবনও নিশ্চয়ই সংকটাপন্ন করে তুলছি! এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের বাপের বাড়িই হয় সব অগতির গতি! তাই আমি আমাদের গুলশানের বাড়ি থেকে সোবহানবাগ সরকারি কলোনিতে আম্মা–আব্বার কাছে এসেছি। সবাই হাল ছাড়লেও আম্মা বর্ণে–গন্ধে, রসে–বিরসে নানা পদের একটার পর একটা খাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিনা যুদ্ধে যিনি হারেন না, তিনিই তো মা!
দৃশ্যটি এ রকম—আমি আমার শোবার ঘরের জানালার ধারে বসে উদাস চোখে বাইরে চেয়ে আছি। আমার সামনে একটি বাসনে লোভনীয় সব বাংলা খাবার। জুঁই ফুলের মতো গরম ভাত, শুকনা মরিচ ও রসুনে ফোড়ন দেওয়া কচি লালশাক, শর্ষে-পটোলের খোসাভর্তার একটা ছোট্ট লাড্ডু আর এক টুকরা কাগজিলেবু। ডানে কাঠের টেবিলের ওপর ডাল ও তশতরিতে কড়কড়ে ভাজা ডিমভরা ইলিশের এক ফালি। পাঁচফোড়ন দেওয়া ঘন জলপাই ডাল আর ভাজা মাছ যেন সুগন্ধের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু আমি বিরস বদনে ডালের চামচটা হাতে তুলে ভাতের ঢিবি খোঁচাচ্ছি আর বাইরে তাকাচ্ছি। এমন সময় আবার আবির্ভূত হলেন আম্মা। ভুরু কুঁচকে একবার তাকালেন মাত্র। তারপরই দ্রুত বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে টান মেরে প্লেটটা নিয়ে সব মাখতে লাগলেন। সেদিন তিনি কী দিয়ে কী মেখেছিলেন, কে জানে, তাঁর মাখা ভাতের গোলাগুলো চাকুমচুকুম গিলতে লাগলাম। কী আশ্চর্য, মাথার ওপরের ফ্যানের হাওয়া ফাগুন হয়ে গেল।
মায়ের হাতের মাখা ভাতের মতোই মায়ের হাতের রান্নায়ও আছে এক অত্যাশ্চর্য জাদু। সে মা অপটু, অগোছালো, ঝানু, আনাড়ি, সবল, দুর্বল যা–ই হোন না কেন, সন্তানের কাছে সে রান্নাই অমৃত। তা ছাড়া পুরো কলোনিতে আম্মার রান্নার ভালোই সুনাম ছিল।
এবার আমার কিশোরী কন্যার গল্প। এ গল্পেও মা আছেন। তিন দশক আগের ঘটনা। আমি তখনো বিলেতে পড়ানোর জন্য আসিনি। ঢাকার পরীবাগে থাকি। তত দিনে আমি এক টিনএজার কন্যা ঈশিতা ও শিশুপুত্র সজীবের মা। সারা দিন ঘূর্ণিঝড়ের মতো নানা কিসিমের কাজের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হই। ঢাকা কলেজে পড়ানো, অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা ও কবিতা লেখালেখি, বিটিভিতে মাসিক বিনোদন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান—সবই করি। এসবের সঙ্গেই চমৎকার একজোড়া গৃহসহকারীকে সঙ্গী করে সংসারও করি। নিজ হাতে রান্নার সুযোগ হয় কদাচিৎ, এখানে আমার নির্দেশনাই মুখ্য। এ রকম সময় প্রায়ই ঘরে ফিরে ঈশিতার মেজাজের মুখোমুখি হতাম। আমার কোনো কিছুই যেন ওর ভালো লাগছে না। একদিন সন্ধ্যায় গানের শিক্ষিকা এলে আমাকে খ্যাপানোর জন্য হারমোনিয়াম না ছুঁয়ে, দুম করে এক কোণে বসে গনগনে গলায় গান গেয়ে উঠে গেল। বিষয় কী? রবীন্দ্রনাথের ‘আমি ভালোবাসি যারে/ সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে’ সূত্রও অচল হতে চলেছে। মেয়ে আমাকে আর ভালোবাসে না। কোন পথে মেয়ের কাছে পৌঁছাই? বিকেলে শুক্রাবাদ থেকে আম্মা বেড়াতে এসে ক্রন্দনরত কন্যাকে শান্ত করতে রাতে নাতনির সঙ্গে থেকে গেলেন। আমি দূর থেকে দেখি সেখানে ‘ভাই ভাই সিনেমা’। আমি যা যা ভালোবাসি, তার কোনো কিছুই কি তাঁর পছন্দ না?
পরদিন আমার রেস থেকে ফেরার পর আম্মা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, তোর মেয়ে তো ঠিকই আছে। তুই–ই তো সময় দিচ্ছিস না। আজ একটু চিকেন কর্ন স্যুপ রাঁধিস।
মানে কী আম্মা?
মানে হলো কাল রাতে সে তার গোপন ডায়েরি আমাকে নিয়ে পড়াল।
এটা তো আমাকে ধরতেই দেয় না!
শোন না...
দেখি এক জায়গায় লেখা আছে, ‘আমার মা খুব ভালো চিকেন কর্ন স্যুপ রান্না করে। শি ইজ দ্য বেস্ট কুক ইন দ্য ওয়ার্ল্ড!’
ঢাকা কলেজের পাশেই নিউমার্কেট। ফেরার সময় ঘোর বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আজ ঈশিতার জন্য চিকেন স্যুপ করব বলে বাচ্চা মুরগি কিনে এনেছি। এবার আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে বৃষ্টি নামল।
শেষ গল্পটি আমার আব্বার প্রয়াণের পর। আমি তত দিনে বিচিত্রার লাইফস্টাইল বিভাগ ‘জীবন এখন যেমন’ সম্পাদনা করি। তাতে রান্নাবান্না, ফ্যাশন, বনৌষধি, যোগব্যায়াম, পকেট আইন—সবই থাকে। আম্মাকে দেখে প্রথম বুঝলাম, নিতান্তই এক গৃহিণী তাঁর দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর পর কত একা হয়ে যান! ইতিমধ্যে নানা উপলক্ষে আম্মার রান্নার স্বাদ চেখে গেছেন আমাদের সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা কলেজে আমার সহকর্মী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আমার সহকর্মী অনেক তারকা বন্ধু। ভাবলাম, আম্মা তো পুঁতির গয়না তৈরি ও সূচিকর্ম এবং রান্না সত্যিই ভালো পারেন। শুধু ভালো নয়, ঘরে তেমন কিছু নেই থেকেও তিন পদ করে ফেলতে পারেন। যদি তাঁকে আবার ব্যস্ত করে তুলি, তবে মা–ও বাঁচবেন। সেই থেকে বিচিত্রায় শুরু হলো আম্মা আনোয়ারা তরফদারের রেসিপি লেখা। স্বাদ স্বাতন্ত্র্যে যা উজ্জ্বল। মাঝেমধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেয়েদের গয়না বানানোর প্রশিক্ষণ দিতেও যেতে লাগলেন। ক্রমে বৃহত্তর পারিবারিক পরিসরেও তারকা হয়ে উঠলেন আম্মা। তাই দেখে একদিন শিল্পতরু প্রকাশনীর বন্ধু কবি আবিদ আজাদকে অনুরোধ করে আমিই বিভিন্ন কাগজ ও বিচিত্রায় প্রকাশিত তাঁর রেসিপিগুলো গুছিয়ে দিই। শাহাদত ভাই আম্মার ছবি তুলে দেন, অলংকরণ করে দেন তরুণ সহকর্মী শিল্পী মাসুক হেলাল, ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় খাদ্যবিলাস। তিন যুগ পর নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রচ্ছদে পাঞ্জেরী থেকেই বেরোল সেই বইয়েরই আরও মার্জিত ও শোভন দ্বিতীয় সংস্করণ।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সে গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দর্শকসারিতে বসে মনে পড়তে লাগল, আম্মা রান্নাঘরে ঢুকলেই কী একটা ম্যাজিক ঘটে যেত। এক শোল মাছ তিন রকমের উপকরণের সঙ্গে মিশে ভিন্ন স্বাদের হয়ে যেত। কোনো কিছুরই খোসা না ফেলে তা দিয়ে হয় ভর্তা, নয় স্টক করতেন। স্যুপ বা কারি রান্নার সময় গরম জলের বিকল্প হতো সে স্টক। গ্রামে গেলে হাঁটতে হাঁটতেই ঝোপঝাড় থেকে তুলে নিতেন বা নেয়াতেন বথুয়া, থানকুনি, বুনো কচু, শেয়ালমূর্তি শাক। কুঁকড়ামুকড়া ঘাড় গোঁজ করা টিয়াসবুজ ঢেঁকিশাকের সঙ্গে টেলে ভিজিয়ে রাখা শিমের বিচি দিয়ে যা রান্না করতেন, তা শুধু খেতে নয়, দেখতেও ভালো হতো।
আগানবাগানের রান্না
আব্বার সরকারি চাকরিসূত্রে আমরা নানান জায়গায় থেকেছি। জামালপুরে আমাদের টিনশেড বাংলো টাইপের বাসার উল্টো দিকে ধাঙড়পাড়ার পেছনে ছিল শজনেগাছ। তার ছাল-বাকল-পাতা-ফল—কী খাইনি! বাসার পাশের পোড়ো বাগান থেকে তোলা হতো ঘন লাল মেস্তা। মেস্তা গোটার লাল খোসা দিয়ে বানাতেন অপূর্ব জেলি আর জ্যাম। আর তার আঙুরপাতার মতো খসখসে টক টক পাতা বেটে ভর্তা, কখনোবা কুচো চিংড়ি দিয়ে ঝোলের মতো টক, আমরা সিলেটিরা যাকে বলি টেঙ্গা বা খাট্টা। কচুপাতা বা ডগা দিয়েও তিনি টেঙ্গা রাঁধতেন আর তাতে গুলে দিতেন তেঁতুল ও এক চিমটি চিনি। মাঝেমধ্যে দিতেন বাটা তিল। সে তিলের কী যে সুগন্ধ!
নারায়ণগঞ্জে ভিক্টোরিয়া আমলের আমাদের দোতলা বাড়ির চত্বরে ছিল কেশববাবুর পুকুর। সেখানে উল্টো কাঁসার কলসি ধরে ভেসে ভেসে মনা ভাই তুলে আনতেন হেলেঞ্চা, কলমি, শাপলা। শাপলার নরম ডাঁটা দিয়ে ইলিশের মাথা ভেঙে মাছ-মসলায় কষাতেন। নামানোর আগে দিতেন তাজা ধনেপাতা। আমি যে কত দিন গৃহসহকারীদের সঙ্গে বাগান থেকে করলা, পাট, লাউয়ের কচি পাতা তুলেছি! খবরের কাগজের ওপর বঁটি পেতে শিল্পীর মতো করে কুটতেন এসব শাকসবজি। খবরের কাগজ হাতে ইজিচেয়ারে বসে আব্বা তা দেখতেন আর আমার বানানো চায়ে চুমুক দিতেন। আমি চোখ গোল গোল করে দেখতাম, আঙুল ঘুরিয়ে পাটপাতার গুচ্ছে কী সুন্দর গেরো দিচ্ছেন আম্মা। তারপর শুধু কাটা পেঁয়াজ, রসুন ও কাঁচা মরিচের সঙ্গে হলুদবাটা, শর্ষের তেল ও জল দিয়ে তা চুলায় চড়িয়ে দিতেন।
তেঁতুল নয়, তেঁতুলপাতার টক
ফেনীতে আমাদের পিটিআই স্কুলের পেছনে একবার বিশাল এক তেঁতুলগাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল। আমি আর বেলি কচি তেঁতুলের আশায় গিয়ে দেখি তেঁতুল নয়, টিয়ারং কচি পাতায় ভরে আছে ডাল। কথাটা বাসায় এসে বলতে আম্মা বললেন, ওই সব পাতায় টক রাঁধলে আর কাঁচা আম লাগে না। অমনি দে দৌড়। এক কোঁচড় পাতা নিয়ে এসে তাঁর কাছে দিয়ে খেলতে চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কচি পাতার কয়েক গোছা ধুয়ে লবণ, মরিচ ও শর্ষের তেলে থেঁতলে বন্ধুদের জন্য নিয়ে গেলাম।
দুপুরে হাজারীর পুকুরে মত্ত সাঁতার শেষে ভাত খেতে বসে দেখি, গজার মাছের অচ্ছুত টুকরা আর বাটা তেঁতুলপাতা দিয়ে সুন্দর সবুজ রঙের একটা টক রান্না করেছেন আম্মা! ভাতে মাখতেই বেরিয়ে এল রসুন ফোঁড়নের সুগন্ধ।
ঈদের রান্নাবান্না
বড় ঈদ মানে কোরবানির ঈদে করতেন ঝাল মাংস, কাবাব ও ঝুরা মাংসের ফব-পিঠা আর ছোট ঈদে সেমাই জর্দা, নারকেলের ফব, মুরগির কোরমা। আমার ছোটবেলায় চটপটি চিনিনি, দইবড়া খাইনি, কেক বা আইসক্রিমের প্রশ্নই আসে না। বাসায় ফ্রিজ নেই যে বরফ খেতে পারি। আমি দুটো ঈদকে নোনতা ঈদ ও মিঠা ঈদ বলে বিভাজন করতাম। দুই ঈদে দুই রকমের গন্ধে ম–ম করত আমাদের মাছের পিঠরঙা টিনশেড রান্নাঘর।
কোরবানির ঈদে গরু বা খাসির অনেক মাংস থেকে সুন্দর সুন্দর মাংসের টুকরা আলাদা করে নিতেন আম্মা। তারপর পাতলা পাতলা করে কেটে নুন ও হলুদে মেখে তারে গেঁথে রোদে শুকাতেন। বেশ কয়েক মাস পর কোনো এক ভরা বৃষ্টির দিনে ঘোষণা দিতেন, ‘আইজ তুমরা গোশতর হুকোইন খাইবায়।’ তারপর বয়ামে তুলে রাখা মাংস বের করতেন। সেই মাংস এক ঘণ্টা গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো। কুয়োপাড়ের পেঁপেগাছের নিচে পড়া কচি পেঁপে শিলে থেঁতো করে মসলাসহ মাখিয়ে রেখে দিতেন এক ঘণ্টা। এখন বুঝি, এর নাম ম্যারিনেট করা। তারপর সেই মাংস আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, কাটা ও গরমমসলা, সামান্য দই দিয়ে চুলায় ভুনে দুই কাপ গরম পানি দিয়ে হালকা আগুনে বসিয়ে রাখতেন বেশ কিছু সময়। আমি মাঝেমধ্যে তাঁর নির্দেশে চেখে দেখতাম মাংস নরম হলো কি না। না হলে আবার একটু জল দিতেন। মাখা মাখা করে রান্না করে গরম ঢিলা খিচুড়ি দিয়ে খেতে দিতেন। আমাদের আবার এক ঈদ হতো। মাছের শুঁটকি তো সব সময়ই খেতাম। বুদ্ধিমতী মায়ের কল্যাণে মাংসের শুঁটকি খেতাম। আসলে ফ্রিজ ছাড়া প্রিজারভেশন আরকি!
কোরবানির ঈদে আম্মার আরেকটা স্পেশাল ছিল নোনতা সেমাই। প্রক্রিয়াটা নুডলসের মতোই। শুধু সেমাইটুকু ঘিয়ে ভেজে লবণ ও ঝাল দিয়ে জর্দার মতো করে তুলে রাখা হতো। আলাদা পাত্রে শুকনা শুকনা করে গরু বা খাসির কিমা রান্না করে নোনতা সেমাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া, ব্যস।
আসলে আমাদের সব মায়ের রান্না এত স্বাদু হওয়ার একটি কারণ হলো প্রচলিত সব উপকরণের ওপরে বাড়তি আরও একটি উপাদান তাঁরা ঢেলে দেন, তার নাম ‘মায়া’, ভালোবাসা।