চাকরি হারিয়ে আবার তিনি ফিরেছেন সিইও হিসেবে

প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ইন্টেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্যাট্রিক পি গেলসিঙ্গার। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।

প্যাট্রিক পি গেলসিঙ্গার
ছবি: ইন্টেলের সৌজন্যে

এই মঞ্চে পৌঁছানো পর্যন্ত আমার যাত্রাটা খুব সাধারণ। পূর্ব পেনসিলভানিয়ার একটি শহরে আমার জন্ম। ঘটনাচক্রে একবার একটা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিই, পেয়েও যাই। কদিন পর জানতে পারি, নিয়ম অনুযায়ী সেই পরীক্ষাটা আসলে আমার পরের বছর দেওয়ার কথা ছিল।
আমার গাইডেন্স কাউন্সেলর বললেন, ‘কিছু কমিউনিটি কলেজ হয়তো তোমাকে নিতে পারে। চেষ্টা করে দেখো।’ মনে হলো আমাকে তিনি বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন! অতএব ১৬ বছর বয়সে আমার কলেজজীবন শুরু হলো।
প্রযুক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। প্রতিটি ক্লাসেই আমি মজা পেতে থাকি। প্রথমবার যখন একটা কম্পিউটার ছুঁয়ে দেখলাম, থমকে গেলাম। দুই বছরের ডিগ্রি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া গেলাম ইন্টেলে সাক্ষাৎকার দিতে। ভাগ্যিস, বিমানের টিকিটের খরচটা ইন্টেলই বহন করেছিল। তাই সে সময় আমার প্রথম বিমানে ওঠার অভিজ্ঞতাটা হলো।
সাক্ষাৎকার যিনি নিয়েছিলেন, তিনি আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা বুদ্ধিমান, একগুঁয়ে, খ্যাপাটে। এ রকম লোকই তো আমরা চাই।’ প্রযুক্তি আমি এতই ভালোবাসতাম যে ইন্টেল দ্রুতই আমার দ্বিতীয় পরিবার হয়ে উঠল। তার চেয়ে বড় কথা, আমাকে ঘোড়ার লাথি খেতে হচ্ছে না, গরুর গুঁতো খেতে হচ্ছে না, খড়ের গাদার ময়লায় মাখামাখি হতে হচ্ছে না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে কাজ করছি, আর কী চাই!

আরও পড়ুন

একসময় ইন্টেলের প্রথম প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেলাম। মাইক্রোপ্রসেসরের ১৪টি জেনারেশন তৈরির যাত্রায় আমি সঙ্গী ছিলাম। ওয়াই–ফাই কিংবা ইউএসবি প্রযুক্তি তৈরির পেছনে কাজ করেছি। আমার নাতনি যখনই ইউএসবি প্লাগ ব্যবহার করে, বলে ‘ধন্যবাদ দাদা।’
স্বপ্ন ছিল ইন্টেলের সিইও হব। কিন্তু ২০০৯ সালে, ৩০ বছর কাজের পর, আমাকে বের করে দেওয়া হলো। মন ভেঙে গেল। ইন্টেলের বাইরে আমার জীবনের ১১ বছর কেটেছে। প্রথমে ইএমসিতে, এরপর ভিএমওয়্যারের সিইও হলাম। এই ১১ বছর ছিল আমার জীবনে শেখা, পরিণত হওয়া এবং নিজেকে গড়ে তোলার এক অনন্য সময়। বছর দেড়েক আগে আমাকে আবারও ইন্টেলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো, সিইও হিসেবে—আমার স্বপ্নের জায়গা। অতএব আমি এখনো স্বপ্নের মধ্যে আছি।
মানুষের জীবনের সবকিছুই ধীরে ধীরে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি কখনো ভালো বা মন্দ হয় না। প্রযুক্তিকে ভালো কাজে লাগানোর দায়িত্বটা আমাদের। যদি ভালো কাজে লাগাতে পারো, বিশ্বাস করো, এটা জাদুর মতো! আর এই ওহাইওতেই তৈরি হবে ভবিষ্যতের জাদু। এই ওহাইওতেই আমরা হাজার একরের বেশি জায়গা নিয়ে একটা কেন্দ্রীয় কার্যালয় গড়ে তুলছি, যেটা ডিজনিল্যান্ডের চেয়ে সাত গুণ বড়। আমরা চাই, এটা হবে পৃথিবীতে সেমিকন্ডাক্টরের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকেন্দ্র।
ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে, এমন কিছু পরামর্শ আমি তোমাদের দেব। আমি একে বলি ক্যারিয়ার ম্যাপ। ম্যাপ, মানে এম-এ-পি।

‘এম’ মানে মেন্টর (পরামর্শক)। একজন মেন্টর খোঁজো, তাঁর কথা শোনো। আমার জীবনে পাঁচজন বিশেষ মেন্টর আছেন। দুঃখজনকভাবে তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন এখনো আমার সঙ্গে আছেন। প্রতি শুক্রবার সকালে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আমি ছিলাম একজন সতর্ক, তরুণ প্রকৌশলী। তখন ইন্টেলের অন্যতম প্রধান পণ্য, ৮০৩৮৬ চিপ নিয়ে কাজ করছিলাম। বারবারই কিছু না কিছু সমস্যার মুখে পড়ছিলাম। ইন্টেলের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সভায় আমি বলেছিলাম, এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা জরুরি। সেই সভার এক-দেড় সপ্তাহ পর আমার কাছে অ্যান্ডি গ্রোভের ফোন এল। কিছুদিনের মধ্যেই যাঁর সিইও হওয়ার কথা। সেমিকন্ডাক্টরের ওস্তাদ, ম্যানেজমেন্ট গুরু, টাইম ম্যাগাজিনের ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি কী করছ? কী পড়ছ? কী হতে চাও?’ আমি রীতিমতো থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা-আমতা করে কী সব আবোলতাবোল বললাম। শুনে তিনি বললেন, ‘বোকার মতো কথা বোলো না। আরও ভালো উত্তর নিয়ে আগামী সপ্তাহে আমার অফিসে হাজির হও।’
সেই থেকে শুরু। পরের ৩৫ বছর, মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ছিলেন আমার মেন্টর। গ্রোভের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারটা ছিল অনেকটা দন্তচিকিৎসকের কাছে গিয়েও অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার না করার মতো। বুঝতেই পারছেন। কিন্তু জীবনটাকে আরও উন্নত করার জন্য এ ধরনের মানুষের প্রয়োজন। অতএব তুমিও তোমার জীবনের অ্যান্ডি গ্রোভকে খুঁজে বের করো।
‘এ’ মানে অডিশাস গোল। দুঃসাহসিক লক্ষ্য। ২৫-২৬ বছর বয়সে আমি কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তত দিনে আমার নামে প্রথম পেটেন্ট হয়ে গেছে, জীবনের প্রথম বই লিখে ফেলেছি। বইটা ছিল একটা থ্রিলার—প্রোগ্রামিং দ্য এইটি থ্রি এইটি সিক্স (ইন্টেলের প্রোগ্রামারদের জন্য একটি ম্যানুয়াল—বি.স.)। তোমাদের অনেকে হয়তো বইটা পড়েছ। তখন আমাদের দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীতে আসি আসি করছে। তবে নিশ্চিত ছিলাম না, ক্যারিয়ারের বাকি অংশটা নিয়ে আমি কী করব।
সেই সময়ই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করি। পরের ২৫ বছর খাতায় আঁকিবুঁকি করার সময় আমি ইন্টেলের সিইওর আসনটাই এঁকেছি। এটাই প্রতিদিন আমাকে এগিয়ে নিয়েছে। এমন লক্ষ্য ঠিক করো, যেটা তোমার কল্পনার চেয়েও বড়।
‘পি’ মানে প্যাশন। এমন কিছু খুঁজে বের করো, যেটা তুমি ভালো পারো, যা নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসো। সেই ১৮ বছর বয়সে ইন্টেলে যে রোমাঞ্চ নিয়ে পা রেখেছিলাম, ৪০ বছর পর সেই একই রোমাঞ্চ নিয়ে আমি অফিসে ঢুকি। যে রোমাঞ্চ তোমার জীবনকে গতিশীল করে, সেটা কখনো হারিয়ো না। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত
সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও