‘তুই পারবি, আমি জানি। তোকে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই’
ক্যাম্পাসে পরিচয়। এরপর বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে একে অপরের শক্তি হয়ে ওঠা, স্নাতক শেষে গাঁটছড়া বাঁধা। শেষমেশ উচ্চশিক্ষা নিতে ভিনদেশের পথেও একসঙ্গে পা বাড়ানো। সহপাঠী থেকে সহযাত্রী হয়ে ওঠা এমনই এক জুটির গল্প শুনুন।
গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে পরিচয়। সেদিনের কথা স্মরণ করে রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘(তানজিল ইসলাম) শোভনের মধ্যে একটা আলাদা পরিপাটি ভাব, শান্ত আত্মবিশ্বাস ছিল—যেটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। আমাদের ক্লাসে অনেকে ছিল, কিন্তু ওর ব্যবহারে একটা বিশেষ ধরনের যত্ন ও দায়িত্ববোধ ছিল, যেটা আমাকে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে যখন তাঁকে চিনতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম—এই মানুষটার ভেতরে একধরনের নীরব শক্তি আছে। আমি সব সময় চাইতাম এমন একজন পাশে থাকুক, যে শুধু কথা বলবে না—আমার কণ্ঠ শুনে বুঝে যাবে আমি ভালো নেই।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ল্যাবে এই দুই মনোযোগী গবেষককে ক্যাম্পাসের অনেকেই হয়তো দেখেছেন। বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা। আলোচনা, পড়াশোনা, ক্লাস-ল্যাবের কাজ করতে করতে বন্ধুত্ব। একসময় ভালোবাসায় রূপ নেয় সেই বন্ধুত্ব। দুজনেই যুক্ত হন বিভাগের গবেষণা ল্যাব—মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড প্রোটিন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে (এমবিপিএসএল)। শুরু হয় তাঁদের প্রকৃত একাডেমিক জার্নি। গবেষণা, রিপোর্ট লেখা, থিসিস—সবকিছুতেই একে অপরের পাশে থাকা ছিল তাঁদের নিত্যদিনের ঘটনা।
রাজিয়া বলেন, ‘গবেষণা করতে গেলে হতাশা আসেই। মাঝেমধ্যে মনে হতো—কিছুই বুঝতে পারছি না, আমার পক্ষে হয়তো রিসার্চ করা সম্ভব না। তখন শোভন একবারও না ভেবে বলত—“তুই পারবি, আমি জানি। তোকে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।” এই শব্দগুলো তখন শুধু সহানুভূতি ছিল না, ছিল নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার শক্তি। ও শুধু আমার সহপাঠী ছিল না—ছিল আমার ভেতরের ভয়গুলো দূর করার মানুষ।’
একবার ব্যাচের রিসার্চ গ্রুপ থেকে বাদ পড়ে যান রাজিয়া, ‘মহামারি চলাকালে যখন প্রায় সবাই রিসার্চে যুক্ত ছিল, তখন আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়—আমি আর রিসার্চের অংশ নই। কেউ জানতেও চায়নি আমি কেমন আছি, পারছি কি না। একধরনের অবহেলা আমাকে গ্রাস করে। তখন শোভন পাশে ছিল। ও শুধু বলেনি যে আমি পারব—ও আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। সেই দিনগুলোই এখন আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।’
সম্পর্কটা যে শুধু একপক্ষীয় ছিল, তা কিন্তু নয়। রাজিয়াও হয়ে উঠেছিলেন তানজিলের ভরসার জায়গা। তানজিল বলেন, ‘আমরা যেখানেই কাজ করতাম—হোক সেটা রিসার্চ বা ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট—চেষ্টা করতাম একে অপরকে বুঝে নিতে, জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতাম না। (রাজিয়া সুলতানা) নিপার চিন্তা করার প্যাটার্ন একটু গভীর, অনেকটা অ্যানালিটিক্যাল। আমি সেই বিশ্লেষণের জায়গা থেকে শেখার চেষ্টা করতাম। আমরা কেউ কাউকে কম করে দেখিনি, বরং দুজনেই বিশ্বাস করতাম—একসঙ্গে আমরা আরও ভালো কিছু করতে পারি।’
চায়ের কাপে আলোচনা, লাইব্রেরির নীরব কোণে বসে থাকা, কিংবা ল্যাবের একঘেয়ে সময়ে দুজনের ছোট ছোট হাসি—এগুলোই তানজিল-রাজিয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। তাই বিয়ের সময় দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। তানজিল বলেন, ‘আমরা সব সময় বিশ্বাস করতাম—আমার সাফল্য মানেই ওর আনন্দ, আর ওর সাফল্য মানেই আমার গর্ব। এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে কখনো নেতিবাচক প্রতিযোগিতা আসতে দেয়নি। বরং আমরা একে অপরের ওপর নির্ভর করেই বড় হতে শিখেছি। কেমন করে যেন একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গিয়েছিল—ওর চোখের দিকেই আগে তাকাই, বুঝতে পারি কী বলতে চাইছে।’
২০২৪ সালের ফল সেমিস্টারে তানজিল ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান, আর ২০২৫ সালের গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারে সুযোগ পান রাজিয়া। তাঁরা এখন কেনেসো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার অব সায়েন্স ইন ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি প্রোগ্রামে পড়াশোনা করছেন। তানজিল গবেষণা করছেন প্রোটিওমিকস নিয়ে, আর রাজিয়া কাজ করছেন অ্যান্টিবায়োটিক ডেভেলপমেন্ট নিয়ে। পাশাপাশি তাঁরা দুজনেই গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নতুন দেশের নতুন বাস্তবতায় নিজেদের মানিয়ে নেওয়া, একাডেমিক চাপ সামলানো আর সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা—সবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবু তাঁরা হার মানেননি। রাজিয়া বলেন, ‘একাডেমিক চাপ ও সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করে চলি, প্রয়োজন হলে একে অপরকে স্পেস দিই এবং ছোট ছোট মুহূর্ত একসঙ্গে কাটিয়ে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে নিই। এই সম্পর্ক শুধুই ভালোবাসা নয়—এটা একে অপরের শান্তির স্থান, নিরাপত্তা এবং নির্ভরতার জায়গা।’