যে কারণে আমি পাঠক থেকে লেখক হই

চলে গেলেন আকবর আলি খান। এক জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই বিচরণ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। ছিলেন সফল আমলা, হয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তাঁর মৌলিক পর্যবেক্ষণ আছে, শিক্ষকতা করেছেন, ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন, আবার স্পষ্টভাষী জনবুদ্ধিজীবী হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য—বিচিত্র বিষয়ে তাঁর গবেষণামূলক বই বোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকের মনও জয় করেছে। কীভাবে তিনি পাঠক থেকে লেখক হয়ে উঠলেন, আত্মজীবনী পুরোনো সেই দিনের কথায় আছে তার স্বাদু বর্ণনা। প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া বইটির সেই নির্বাচিত অংশটি এখানে তুলে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’।

আকবর আলি খান
ছবি: প্রথম আলো

আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে একটি সাদাসিধা বালকের বড় হওয়ার কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। বালকটির জন্ম হয়েছিল নবীনগর থানার জলাভূমিতে।

আরও পড়ুন

দৌড়ঝাঁপ বা খেলাধুলা তার পছন্দ ছিল না। কল্পনাবিলাসী এবং অন্তর্মুখী বালকটি বই পছন্দ করত কিন্তু ভালো বই পাওয়া ছিল কঠিন। একমাত্র পাঠাগার ছিল নবীনগর হাইস্কুলে। পাঠাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষক তাকে বেশি বই পড়তে দিতে চাইতেন না। শিক্ষকদের ধারণা ছিল, পাঠ্যবই পড়াই যথেষ্ট। পাঠ্যের বাইরের বই (যাকে বলা হতো আউট বই) পড়ে খুব লাভ হয় না। বই পড়ার জন্য বালকটি বই বিক্রেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। বইয়ের দোকানে যেসব ‘আউট বই’ পাওয়া যেত, সেগুলো পড়েছে; কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। যেখানে যা কিছু লিখিত পাওয়া যেত, সবই সে পড়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি মুদিদোকান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার পুরোনো খাতা সের দরে কিনে এনে পড়েছে। পয়সার অভাবে বাইরের বই কেনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সামান্য টাকা নিয়ে সে বাড়ি থেকে ১০ মাইল দূরে শ্রীঘর বাজারে পুরোনো বই কিনতে গিয়েছিল। শ্রীঘর বাজার ছিল ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগের বাজার। সেই বাজারের একটি বড় অংশে পুরোনো বই বিক্রি হতো। এই বাজার থেকে বই কিনে এনে সে পড়েছে।

তার জন্য ভালো বইয়ের অভাব অনেক কমে যায়, যখন সে ঢাকায় কলেজে পড়তে যায়। ঢাকা কলেজ লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে পরিচালিত পাঠাগার, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির মতো পাঠাগারে যখন খুশি সে যেতে পারত। বৃত্তির টাকা দিয়ে সিনেমা পত্রিকা থেকে শুরু করে দর্শনশাস্ত্রের দুরূহ বইও কিনে পড়ার চেষ্টা করত। বালকটির এই পড়ার অভ্যাস কখনো কমেনি। যখন যেখানেই কাজ করুক না কেন, সময় পেলেই সে বই পড়ত। স্বল্পমূল্যে অনেক পুরোনো বিদেশি বই কিনেছে, আবার চড়া দামে অনেক নতুন বইও কিনেছে।

আমি মূলত বুকওয়ার্ম বা গ্রন্থকীট। সজ্ঞানে লেখক হতে চাইনি, পাঠকই থাকতে চেয়েছি। লেখক হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয়। পাঠকের কাজ অনেক সহজ। তাই আমি বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু কোনো বই লিখিনি। যখন বই লেখা শুরু করি, তখন আমার বয়স ৫০ অতিক্রম করেছে।

দুটি কারণে আমি পাঠক থেকে লেখক হই।

পড়তে পড়তে দেখতে পাই যে বিভিন্ন প্রশ্নে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। অনেক প্রশ্নের কোনো জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সেসব প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা করা শুরু করি। চিন্তা করতে করতে অনেক ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। আমার মনে হয় যে অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে আমারও কিছু বক্তব্য দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়গুলো ছকবাঁধা গৎ-এর মধ্যে পড়ে না। অবশ্যই ইতিহাস সম্বন্ধে মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে; অবশ্যই অর্থনীতি সম্বন্ধে প্রশ্ন জেগেছে; প্রশ্ন জেগেছে লোকপ্রশাসন সম্পর্কে; প্রশ্ন জেগেছে সুশাসন সম্পর্কে; প্রশ্ন জেগেছে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে; প্রশ্ন জেগেছে সাহিত্য সম্পর্কে; আবার প্রশ্ন জেগেছে দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে। যেকোনো বিষয়ে যখনই মনে হয়েছে আমার নিজস্ব কিছু বক্তব্য আছে, সেখানেই আমি কিছু লেখার চেষ্টা করেছি। নিজস্ব কোনো বক্তব্য না থাকলে অন্যের বক্তব্য প্রচার করার জন্য কোনো বই লিখিনি।

বই লেখার আমার দ্বিতীয় কারণ হলো অনেক বই পড়তে আমার ভালো লাগত। এই ভালো লাগাটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করত। বিশেষ করে যখন দ্বিতীয় দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে গেলাম, তখন অর্থনীতির অনেক তত্ত্ব আমাকে আলোড়িত করে। অর্থনৈতিক তত্ত্বের সৌন্দর্য রয়েছে, আমার ইচ্ছা করে এই সৌন্দর্য সবার সঙ্গে উপভোগ করি। বিশেষ করে যেসব অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের ধারণা সাধারণ পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিই। তবে পণ্ডিতদের জন্য লিখি অথবা সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখি না কেন; সর্বত্রই বই লেখার পেছনে আমার অনেক বছরের চিন্তা ও ভাবনা রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করার পর আমাকে কয়েক হাজার সাক্ষাৎকার গণমাধ্যমের কাছে দিতে হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা এবং সাময়িকীতে কলাম লিখতে হয়েছে। বেশ কয়েকজন প্রকাশক এসব সাক্ষাৎকার এবং কলাম থেকে লেখা নির্বাচন করে বই প্রকাশের জন্য আমাকে অনুরোধ করেছেন। আমি রাজি হইনি। সাক্ষাৎকার এবং কলামে আমি যা বলেছি, সেগুলো শুধু তৎকালীন পরিবেশে প্রযোজ্য। কিন্তু আমি আমার বইয়ে যা লিখেছি, তা আমার বিশ্বাস অনুসারে সর্বকালেই সত্য।