অবসর সময় যদি রাজনীতির পেছনে খরচ করি, গবেষণা করবে কে?
ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে চলছে নানা আলাপ। শিক্ষার্থীরা কী বলছেন?
রাজনীতি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে
আনিকা তাহসিন, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি মনে করি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি থাকা উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি প্রবেশ করলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য—জ্ঞান সৃজন ও অন্বেষণ থেকে বিচ্যুত হয়। রাজনীতি প্রায়ই দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন এবং সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি করে। পড়াশোনার ক্ষতি হয়, প্রকৃত লক্ষ্য থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে সরে যান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনীতি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির পরিবর্তে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। যখন কোনো শিক্ষার্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন, তাঁরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। এটি তাঁদের সামাজিক নেটওয়ার্ককে যেমন দুর্বল করে, একই সঙ্গে শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি না থাকাই উত্তম। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে পারবেন । সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
স্বচ্ছ ও গঠনমূলক রাজনীতি চর্চা করা যেতে পারে
খাইরুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ ছাত্রদের অধিকার রক্ষা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত। তবে তা অবশ্যই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। নতুবা নৈরাজ্যনীতির এই চর্চা বন্ধ হবে না। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও কিন্তু ছাত্ররাজনীতি আছে। পার্থক্য হলো, সেটি ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতির ‘ডার্ক ওয়ে’ নীতি অনুসরণ করে না। বাংলাদেশে সেই একই প্রেক্ষাপটে স্বচ্ছ ও গঠনমূলক রাজনীতি চর্চা করা যেতে পারে। তবে আমাদের দেশে এ ধরনের রাজনীতি বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব, সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ, রাজনীতির উদ্দেশ্য, বিধেয় বলতে আমাদের মস্তিষ্ক বোঝে অন্তহীন ক্ষমতা, আর্থিক লালসা, ইত্যাদি। এই মতাদর্শ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন যদি সম্পূর্ণ বের হয়ে স্বচ্ছ, স্বাভাবিক রাজনীতি করতে ইচ্ছুক হয়, ক্যাম্পাসে তাদের স্বাগত জানাই।
রাজনীতি সম্পর্কে পড়ে বা দেখেও রাজনীতি সম্পর্কে জানা যায়
মিরাজ বাবু, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সঙ্গে একমত। যে রাজনীতি পড়তে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, শান্তিতে থাকতে দেয় না, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মতপ্রকাশ করতে দেয় না; চাঁদাবাজি-রংবাজি, হল দখল করে, হলে হলে টর্চার সেল তৈরি করে, বুলিং-র্যাগিং ও ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে—সেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক, আমিও চাই। আমরা জানি, প্রতিবছর দেশের ১৩০৫ জন শিক্ষার্থী বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পায়। তাদের কাছে দেশ ও জাতির অনেক প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু আমরা যদি অবসর সময় রাজনীতির পেছনে খরচ করি, তাহলে গবেষণা করবে কে? হ্যাঁ, এখন আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে জানার সময়। তাই বলে এই নয় যে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে আমরা যুক্ত থাকব। রাজনীতি সম্পর্কে পড়ে বা দেখেও রাজনীতি সম্পর্কে জানা যায়। কেউ নিজের ইচ্ছায় রাজনীতি করলে বা শিখতে চাইলে তাঁকে কে বাধা দেবে? এর জন্য পুরো ক্যাম্পাসে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। তারপর থেকেই বুয়েট বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে আগের তুলনায় অনেক দূর এগিয়েছে। অন্যায়, জুলুমের রাজনীতি না থাকলে আমরা র্যাঙ্কিংয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাব। আমাদের ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা দেশের উন্নতিতে আরও অবদান রাখতে পারবে।