২০১৯ সালের ২৯ জুন ‘তাঁরাও অভিভাবক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। প্রতিবেদনের ওপরের অংশে একঝাঁক ঝলমলে কিশোর-তরুণের মাঝে আমার ছবি। প্রতিবেদনটির কল্যাণে ঠিক কী কাণ্ড ঘটে গেছে, তাৎক্ষণিক সেটা বুঝে উঠতে পারিনি! দু-এক দিনের মধ্যেই বোঝা গেল। প্রচুর মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করল। যাঁরা এত দিন আমাদের উদ্যোগকে নিছক পাগলামো ঠাওরেছিল, তাঁরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল।
বিষয়টি গোড়া থেকে বলা দরকার। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিলাম আমরা। কার্যক্রমের নাম ‘মোরাল প্যারেন্টিং’ বা নৈতিক অভিভাবকত্ব। ভাবনাটা এ রকম—নিজ সন্তানের পাশাপাশি সমাজের আরেকজন অনাত্মীয় সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করা। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি দীর্ঘদিন সন্তান-স্নেহে দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেওয়া হয় এই বৃত্তি। টাকার অঙ্কটি খুব বেশি নয়। কিন্তু অঙ্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গড়ে ওঠা সম্পর্ক। যে সম্পর্ক শুধু বৃত্তি দান-গ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মা-বাবা-সন্তানের এক চিরায়ত সম্পর্ক। প্রথম দিকে নিজ এলাকার অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে বের করা শুরু করলাম। এ রকম কাউকে পেলে তার দায়িত্ব নিতে পরিচিত বন্ধুবান্ধবকে অনুরোধ করতাম। এভাবে দুই বছরে মোট ৮৬ জন আগ্রহী অভিভাবকের সঙ্গে ১৮০ জন ছেলেমেয়েকে যুক্ত করতে সক্ষম হই।
পরিচিতজনদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়ে মনে হলো, এই ভাবনাকে আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম হলরুমে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতিতে বর্ণনা করা হলো আমাদের নৈতিক সমাজ গঠনের স্বপ্নের কথা। আমরা চ্যারিটির প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে একটু নতুনভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। দান-খয়রাত বা করুণা নয়, বরং নিজ সন্তানের পাশাপাশি সমাজের আর একটি সন্তানকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়া, তার স্বপ্নপূরণে অভিভাবকের মতো পাশে থাকা—এই আমাদের স্বপ্ন। আমরা কিছু ভালো মানুষের সমন্বয়ে এমন একটি পরিবার গড়তে চেয়েছি, যেখানে কেউ হবেন মোরাল প্যারেন্ট বা নৈতিক অভিভাবক আর কেউ মোরাল চাইল্ড বা নৈতিক সন্তান। মোরাল প্যারেন্ট তার মোরাল চাইল্ডকে সন্তানের মতো তার স্বপ্নপূরণে সার্বিক সহায়তা দেবেন। একইভাবে মোরাল চাইল্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়ে অন্যদের পাশে দাঁড়াবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে তাঁরা মুগ্ধ হলেন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তখন থেকে আনিসুল হক ও চঞ্চল চৌধুরী মোরাল প্যারেন্ট হিসেবে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজন ছাত্র এবং ফরিদপুর মেডিকেলের একজন ছাত্রীকে সহায়তা দিয়ে আসছেন।
অনুষ্ঠানের পরপরই প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত হলো ওই প্রতিবেদন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চার বছর ধরে আমাদের স্বপ্ন যত মানুষের মধ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলাম, ওই একটা প্রতিবেদন যেন তার চেয়ে সহস্রগুণ শক্তি হয়ে দেখা দিল। মূলত ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই আমরা ঘরোয়া গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিলাম। বর্তমানে দেশজুড়ে হাজারেরও বেশি মোরাল চাইল্ড, দেশে ও প্রবাসে প্রায় ৫০০ জন মহৎপ্রাণ মোরাল প্যারেন্ট মোরাল প্যারেন্টিং পরিবারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
আমাদের স্বপ্ন অনেক বড়। সমাজের ভালো মানুষদের সমন্বয়ে একটি নৈতিক পরিবার গড়ার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই পরিবারের বন্ধন রক্তের নয়, আত্মার। এই পরিবার একদিন অনেক বড় হবে। আর আমরা আমাদের স্বপ্নের নৈতিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখব। আমাদের এই স্বপ্নের পথে পাশে থাকার জন্য ‘ছুটির দিনে’কে ধন্যবাদ।