ঢাকায় এই ‘গাছের জাদুঘরে’ আছে সাড়ে তিন লাখ প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা
বৃক্ষমেলায় কত না বৃক্ষের সমারোহ। ক্রেতা আসেন, ঘুরেফিরে দেখেন, পছন্দসই গাছ কিনে নিয়ে যান। এই তো বৃক্ষমেলার প্রতিদিনের দৃশ্য। তবে গাছ কেনাবেচার স্টল ছাড়াও এমন কিছু স্টল আছে মেলায়, যা শুধু প্রদর্শনীর জন্যই। বৃক্ষমেলার ৩৭ নম্বর স্টলটিও তেমনই। এটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের স্টল।
স্টলের তাকে তাকে সাজানো বিভিন্ন গবেষণাপত্র, বই, লিফলেট। চোখে পড়ে ‘হারবেরিয়াম শিট’, অর্থাৎ যে কাগজে গাছের শুকনা ফুল-পাতা লেপটে রেখে সংরক্ষণ করা হয়। কাগজের কোণায় উল্লেখ থাকে গাছের বৈশিষ্ট্য ও আনুষঙ্গিক তথ্য।
পাশের এক তাকে চারকোনা কাঠের ফ্রেম। সেই কাঠের ফ্রেমে চাপ দিয়েই মূলত কাগজের ওপর চ্যাপটা করে সংরক্ষণ করা হয় গাছের নমুনা। কাচের জারের চেয়ে এভাবে অল্প জায়গায় নমুনা সংগ্রহ করা যায় অনেক।
আছে স্বচ্ছ কাচের জারে রেক্টিফাইড স্পিরিটে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা। আছে বন কাকরোল, বন কুচিলা, বন আঙুর, মাকাল ফল, মুলিবাশের ফল, আতাবেগুন, ধনেশ টুকরি, জংলি বাঙ্গি, ডেউয়া, উড়ি আম।
শুষ্ক অবস্থায় কাঁচের বয়ামে সংরক্ষণ করা বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা ও প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যও চেখে পড়ল। যেমন ঢ্যাঁড়সগাছের দড়ি, বড় উদালের দড়ি, উদালের ফল, উলটকম্বল, গিলা বীজ, কুঁচ, সয়াবিন।
স্টলের সামনের উঠানে ঘুরে ঘুরে দেখে চেনার জন্য আছে কম চেনা বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। মাটির টবে বসানো প্রতিটি চারার সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে আছে গাছের পরিচয়, ব্যবহার ও উপকারিতা। যেমন পাইন, গন্ধ ভেদুলী, নোনা আতা, ননিফল, নাগলিঙ্গম, আকন্দ, সর্পগন্ধা, বাক্সবাদাম, নাগেশ্বর, গুলঞ্চ, কারিপাতা, বিড়িপাতা বা কুম্ভী, পালাম, করঞ্জা, রক্তফল, রক্তন, কুকুরচিতা, পুন্নাগ, ধারমারা, ঢোলসমুদ্র, বল্লা আঠা, জগ অশ্বত্থ, তমাল, গুটগুইট্টা, আম চুন্ডুল, তুরুকচন্ডাল, হাড়জোড়া, বুদ্ধ নারকেল, নিম, নিশিন্দা, কানাইডিঙ্গা, চন্দ্রমুলা বা ময়ূরী আদা, মহুয়া, বহেরা, শতমূলী, গোজা হরিণাসহ অনেক প্রজাতির গাছের সংগ্রহ।
কথা হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, হারবেরিয়াম হলো বাংলাদেশে কত প্রজাতির গাছ আছে, গাছের অবস্থান কোথায়, কোন গাছ কী পরিমাণে আছে, কোন গাছ কী কাজে লাগে, কোন কোন গাছ বিলুপ্তির পথে, সেসব নিয়ে গবেষণার জায়গা।
মেলায় স্টল দেওয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘বৃক্ষমেলায় অনেক মানুষ আসেন। আমাদের গবেষণালব্ধ কাজ জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার চমৎকার সুযোগ এটা। ভুল প্রজাতির গাছ কিনে যেন ঠকতে না হয়, তার জন্য একটা পরামর্শকেন্দ্রের কাজ করছে আমাদের এই স্টল। যাঁরা গাছ নিয়ে গবেষণা করেন, বিশেষ করে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখানে আসেন আগ্রহ নিয়ে। প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের কোর্সের অংশও এই হারবেরিয়াম, যেখান থেকে ২৫ নম্বরের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।’
শুরুর কথা
মেলার বাইরে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের ঠিকানা মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পাশে। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ ‘বোটানিক্যাল সোসাইটি অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সালার খান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ ইসমাইল।
দেশ স্বাধীন হলে নাম হয় ‘বোটানিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ এবং ১৯৭৫ সালে এসে হয় ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম’।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাঠপর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির গাছ। আবিষ্কৃত গাছের বেশির ভাগই হচ্ছে কচু–জাতীয় উদ্ভিদ। এ ছাড়া শনাক্ত হয়েছে ও বইয়ে প্রকাশ হয়েছে এক হাজার প্রজাতির বিলুপ্ত উদ্ভিদের তালিকা।
প্রকাশিত হচ্ছে তথ্যবহুল গবেষণা গ্রন্থ। প্রতিবছরই প্রকাশিত হচ্ছে ‘বুলেটিন অব বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম’, ‘ফ্লোরা অব বাংলাদেশ’ নামের প্রকাশনা।
গাছের জাদুঘর
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম হচ্ছে ‘গাছের জাদুঘর’। যেখানে এক ছাদের নিচেই আছে সাড়ে তিন লাখের বেশি উদ্ভিদের নমুনা। সবচেয়ে পুরোনো যে নমুনাটি সংগ্রহে আছে, তা ১৮৯৫ সালের। এক দেশ থেকে অন্য দেশের হারবেরিয়ামে গাছের নমুনা বিনিময়ের মাধ্যমে আসে অতি পুরোনো এই গাছের নমুনা।
নানা উপায়ে সংরক্ষণ করা উদ্ভিদ ও বীজে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে প্রবেশ করতে কোনো টিকিট লাগে না। সরকারি ছুটির দিন বাদে যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন এই গাছের জাদুঘর থেকে।