হাতে–কলমে শিক্ষায় সমৃদ্ধ তাঁরা

ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহায়তায় মাত্র ২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু করে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ। ২০২১ সালে এটির নতুন নাম হয় কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গত ৬২ বছরে স্নাতক করেছেন হাজারো শিক্ষার্থী। তাঁদের অনেকেই এখন উদ্যোক্তা বা পেশাজীবী হিসেবে ভালো অবস্থানে আছেন। পড়ুন এমনই কয়েকজনের গল্প

কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের ক্যাম্পাস
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

হাতে-কলমে কাজ শেখার সুফল এখনো পাচ্ছি

নাহিদ আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা, আরবান সেটার, যুক্তরাষ্ট্র

বস্ত্র পরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প (ক্লদিং অ্যান্ড টেক্সটাইল) বিষয়ে আমি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করি। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তুলব। কলেজে আমাদের প্রতিটি বিষয় হাতে-কলমে শেখানো হয়েছে, যার সুফল এখনো ভোগ করছি। কলেজে পড়ার সময়ই পোশাকশিল্প নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছি। আর তা বাস্তবায়ন করেছি সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে, নিজের টেক্সটাইল ব্র্যান্ড গড়ে তুলে। এখন আমাজনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশি পণ্য তুলে ধরছি।

স্নাতকে আমি দ্বিতীয় আর স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পেয়ে পাস করেছিলাম। এরপর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে এসিবিএ করি। ব্যবসায় প্রশাসনের এই উচ্চতর কোর্স নিজেকে তৈরি করতে আরও সাহায্য করেছে।

মাস্টার্সে পড়ার সময়েই বাংলাদেশের একটা নেতৃস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই। সেখানে ১৫ বছর সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছি। এখন নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে স্বাস্থ্য খাতে সার্ভিস কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত আছি। আমার পরিচিত যাঁরা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে থেকে সে সময় পড়ালেখা করেছেন, তাঁদের বড় একটা অংশই সাফল্যের সঙ্গে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করছেন।

বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি

নুসরাত জাহান, ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান, ল্যাবএইড হাসপাতাল

স্নাতক-স্নাতকোত্তরে আমার মূল বিষয় ছিল খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান। ২০০৪-০৫ সেশনের ছাত্রী ছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়সংশ্লিষ্ট পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন মৌলিক বিষয় পড়ার সুযোগ পেয়েছি বলেই আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যা এখন কাজে লাগছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কর্মমুখী শিক্ষা বলেই হয়তো কলেজ থেকে পড়ে অনেকে কর্মবাজারে অবদান রাখতে পারছে।

স্নাতক-স্নাতকোত্তর দুটিতেই প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলাম। স্নাতকে মেধাবৃত্তি ছিল। এখন ল্যাবএইড হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান এবং ডায়েট কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি। আউটডোর রোগী দেখি। অপুষ্টিজনিত রোগের কারণে যাঁরা সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ দিই। প্রায় ১২ বছর ধরে এই খাতে কাজ করছি। পুষ্টিসেবা দেওয়ার পাশাপাশি গণস্বাস্থ্য গবেষণায়ও আমার আগ্রহ আছে। তাই কলেজ থেকে বেরোনোর পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুলের মিক্সড রিসার্চ নিয়ে বিশেষ কোর্স করেছি। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে গণস্বাস্থ্যের ওপর পেশাদার ডিগ্রিও নিয়েছি।

আমি মনে করি, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে একজন শিক্ষার্থী শুধু যে তাঁর বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন, তা নয়, বরং পেশাজীবনে প্রবেশ করতে তাঁর যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলোও অনেকাংশে পাওয়া হয়ে যায়।

সোনিয়া বেগম, অধ্যক্ষ, কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্স
ছবি: সংগৃহীত
অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে পড়ে পেশাজীবনে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই, ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে হয়। আদতে আমাদের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। হাতে–কলমে শেখার সুযোগ থাকে বলেই সব ধরনের পেশায় আমাদের শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জিং ভূমিকায় দেখা যায়। সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস থেকে শুরু করে পুলিশ-ট্যাক্স কিংবা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থান উজ্জ্বল। উদ্যোক্তা হিসেবেও অনেকে এখন ভালো করছে। একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তার সব জ্ঞানই ছাত্রীরা পাঠ্যক্রম থেকে পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাদানকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের শিক্ষাকাঠামো এমন ভাবে ডিজাইন করা হয় যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন থেকেই নানা কাজে যুক্ত থাকে। আমাদের সিলেবাস ও পড়াশোনার বিষয় কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে তৈরি, যে কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগও নিচ্ছে। প্রতিবছরই আমরা সিলেবাসে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করছি।
সোনিয়া বেগম, অধ্যক্ষ, কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্স

দেশে-বিদেশে কাজের সুযোগ মিলছে

নুসরাত ফাতেমা, উদ্যোক্তা

কলেজে আমার বিষয় ছিল বস্ত্র পরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প। পড়া শেষ করেই নিজস্ব উদ্যোগে বুটিক চালু করেছি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এখন ই-প্ল্যাটফর্মসহ অনেক সুযোগ বিস্তৃত হলেও সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়েছি বলেই অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে।

ঢাকায় তখন আমার বুটিক শপের দুটি শোরুম ছিল। পুরো ব্যবস্থাপনা আমি আমার বিভাগের দুই জুনিয়র সতীর্থকে নিয়ে সামলেছি। কয়েক বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার পর যুক্তরাজ্যে যাই। সেখানে কোপেনহেগেন ফ্যাশন স্কুল ও ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে টেকসই ফ্যাশন ও হিলিং উইথ দ্য আর্ট বিষয়ে অনলাইন কোর্স করি। এ ছাড়া লন্ডন ফ্যাশন উইক, পিউর লন্ডনসহ বিভিন্ন মেলা ও ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম, যা আমাকে বৈশ্বিক ফ্যাশনের ট্রেন্ড সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে।

ফ্যাশন–দুনিয়ার অনেক তত্ত্বই কলেজে আমাদের শেখানো হয়েছিল। সেই আলোকে আমি পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষের সামনে আমাদের ফ্যাশন-গার্মেন্টসসহ দেশীয় নানা ঐতিহ্য উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছি। আমাদের স্নাতকেরা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে পড়া শেষ করে যেমন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন, তেমনি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দারুণ কর্মদক্ষতা দেখাচ্ছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার মতো নানা সুযোগ নিচ্ছেন এ সময়ের শিক্ষার্থীরা।

পড়া শেষ করার আগেই উদ্যোক্তা

সাফিয়া সাথী, ফ্যাশন উদ্যোক্তা

২০১০-১১ সেশনে আমি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ বিভাগে ভর্তি হই। অন্য বিষয়ে পড়ার সুযোগও হয়তো ছিল। কিন্তু কোন এলাকায় ক্যাম্পাস হলে পড়া ও কাজ একসঙ্গে করতে পারব, ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকেই সেটা মাথায় ছিল। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে নিজের আগ্রহকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই দেরি না করে কাজ শুরু করতে পেরেছি। পড়াশোনা শেষ করার আগেই উদ্যোক্তা হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়। যেহেতু সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ বিভাগে পড়েছি, তাই ক্লাসরুম থেকে সরাসরি শেখার সুযোগ পেয়েছি। প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও কর্মী ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো শিখেছি। স্নাতকে পড়ার সময় থেকেই ফ্যাশন–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিতাম।

প্রথম দিকে অনলাইনে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বিস্তৃত করেছি। ওয়েডিং প্ল্যানিংসহ নানা সৃজনশীল কাজে যুক্ত থেকেছি, দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক আয়োজনে বাংলাদেশের পণ্য উপস্থাপন করেছি। এখন সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের জন্য পোশাকের নকশাও করছি নিয়মিত। গণ্ডি, জেকে ১৯৭১, অবিনশ্বরসহ বেশ কয়েকটি ছবিতে কস্টিউম ডিরেক্টর হিসেবে কাজের সুযোগ হয়েছে। ২০২২ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল ইয়ুথ সামিটে সৃজনশীল তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছি সম্মাননা।

ছাত্রাবস্থায় বিষয়ের ব্যাপকতা অনেকেই ধরতে পারে না

সৈয়দা ফারজানা জামান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ার অপূর্ণ ইচ্ছেটা আংশিকভাবে পূরণ করার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম পুষ্টিবিজ্ঞানে। পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে যত মিথ আছে, তার মধ্যে একটি হলো—এখানে রান্না শেখানো হয়। অতএব এ বিষয়ে পড়লে নাকি ‘ভালো’ বিয়ে হয়।

এসব কথার তোয়াক্কা না করে এ বিষয়ে পড়ে নিজ যোগ্যতায় আমাদের মেয়েরা এখন দেশ-বিদেশে কাজ করছে। তবে এই বিষয়ের জাদুকরি প্রভাব ছাত্রাবস্থায় অনেকেই জানতে পারে না। যেমন বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শিশু ও নারীর স্বাস্থ্য, পুষ্টি নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, আমাদের সময়ে আমরা তা একেবারেই আঁচ করতে পারিনি। যথার্থ দিকনির্দেশনার অভাবেই হয়তো অনেকে ভিন্ন পেশায় নোঙর ফেলেছেন। যেমন আমি! ছাত্রাবস্থা থেকে লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় ঝুঁকে যাওয়ায় পেশাজীবন সেদিকেই এগিয়েছে। দেখতে দেখতে ২০ বছর হয়ে গেছে। নিজের এজেন্সি থেকে নানা মাধ্যমে কাজ করছি। দেশি-বিদেশি নানা সংস্থায় যোগাযোগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদে যুক্ত থেকেছি। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছি বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রতিষ্ঠানে।

যোগাযোগ খাতের এই দক্ষতাকে পুষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে আমার ব্যাচমেট, যাঁরা নিজ গুণে এখন পুষ্টি ও ডায়েট নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সবাইকে নিয়ে একটা কিছু করার ইচ্ছা আছে। কারণ, যেই সুস্বাস্থ্য বা নিয়মতান্ত্রিক জীবনের কথা আমরা বলি, চর্চার কথা চিন্তা করি, সবকিছুর সঙ্গেই ডায়েট ও পুষ্টি সম্পর্কিত। একে সহজে, সহজলভ্য করে মানুষের সামনে নিয়ে আসলেই অপুষ্টিতে ভোগা বহু জনপদ লাভবান হবে।