এমনও দিন গেছে, নিজেকে কার্টুনের মতো মনে হয়েছে

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় পপতারকাদের একজন অ্যান ম্যারি। এই ব্রিটিশ সংগীতশিল্পীর ‘ফ্রেন্ডস’, ‘রক-আ-বাই’, ‘২০০২’, ‘চাও আদিওস’—গানগুলো দীর্ঘদিন বিলবোর্ড টপচার্টে ছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই শিল্পী বলেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ের সংগ্রামের কথা। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।

ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী অ্যান ম্যারি
ছবি: উইকিপিডিয়া

ছেলেবেলায় আমার প্রিয় খাবারগুলো ছিল ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। মিষ্টি যেকোনো খাবার থাকত পছন্দের তালিকায়। এমনকি শুধু শুধু চিনি খেতে দিলেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের গাড়িতে কাটত। আমি আর আমার বোন গাড়িতে বসে নানা ধরনের খেলা খেলতাম। একটা খেলা ছিল—গাড়ির সামনের আসনটাকে ক্যামেরা বলে ধরে নেওয়া। আমরা পেছনের সিটে বসে পপতারকা হওয়ার ভান করতাম, যেন ক্যামেরাগুলো আমাদের গতিবিধি ভিডিও করছে! বিরাট হইহুল্লোড় বাধিয়ে দিতাম পেছনের সিটে বসে, আর সেই চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত মা-বাবা।

চূড়ান্ত রকমের চঞ্চল ছিলাম। স্কুলের পাশাপাশি প্রতি শনিবার নাচের স্কুলে যেতাম। ওই বয়সেই গান আর থিয়েটারের প্রেমে পড়ে যাই। জীবনে প্রথম পারিশ্রমিক ছিল লা মিজারেবল-এ অভিনয় আর গানের জন্য। প্রতিটি শোর জন্য পেতাম ৩০ পাউন্ড করে। ওইটুকু বয়সে পারিশ্রমিক পেয়ে নিজেকে বেশ ধনী লাগত! দারুণ সময় ছিল সেটা। শৈশবের পুরোটাই ভীষণভাবে উপভোগ করেছি।

অন্যের চোখে দেখা

দিন দিন যত বড় হয়েছি, তত উপলব্ধি করেছি, বড়বেলাটা ঠিক আমার জন্য না। আমি এত চঞ্চল, উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলাম, মনে হতো বড় হতে হলে এই স্বভাবগুলোর লাগাম টানতে হবে। আর এই লাগাম টানাতে আমার কখনোই সায় ছিল না।

নাচ-গানের পাশাপাশি ছিলাম কারাতে চ্যাম্পিয়ন। যখন যা-ই করতাম, তাতেই সেরা হতে চাইতাম। সব খেলায় আমার জিততে হবে, সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে। আমি সেই বাচ্চাটা ছিলাম, খেলায় না জেতা পর্যন্ত যাকে দমানো যেত না, থামানো যেত না। তবে এই উদ্যমটা শুধু খেলা, গান, নাচ, কারাতে—এসব ঘিরেই ছিল। যখন পড়াশোনার প্রসঙ্গ আসত, আমার মনোযোগ মোটেও বইপত্রে ধরে রাখা যেত না।

মনোযোগের এই ঘাটতির পেছনে যে এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার) আছে, কলেজে ওঠার আগপর্যন্ত কেউই বুঝত না। তাই বেড়ে ওঠার সময়টায় অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। শিক্ষকেরা বেখেয়ালি, অমনোযোগী ভাবতেন। অথচ মনোযোগ ধরে রাখার জন্য আমার একরকম নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা লাগত। স্কুলের পড়া মনে রাখতে পারতাম না, এ জন্য অনেকে ‘গোল্ডফিশ! গোল্ডফিশ!’ বলে খ্যাপাত। কী যে বিব্রতকর ছিল সেই সময়টা।

যত বড় হতে থাকলাম, মানুষের কথাগুলো তত বেশি আমার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করল। এডিএইচডির সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্নতাও পেয়ে বসল। একদম ছোটবেলার উৎফুল্ল ‘আমি’ মাধ্যমিকে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেল! চুপ হয়ে যেতে থাকলাম। যখন আমি কৈশোরে, তখন মনে হতো নিজের জন্য না, অন্যের চোখে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। যে দলে স্কুলের সবচেয়ে আলোচিত ছেলেমেয়েরা থাকে, সেই দলের অংশ হওয়ার জন্য নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগাকেও উপেক্ষা করতে শুরু করলাম। নিজেকে খুশি করার চেয়ে, মানুষের চোখে নিজেকে সুখী দেখানোটাই জরুরি মনে হতো তখন।

তাঁর ‘ফ্রেন্ডস’, ‘রক-আ-বাই’, ‘২০০২’, ‘চাও আদিওস’—গানগুলো দীর্ঘদিন বিলবোর্ড টপচার্টে ছিল
ছবি: উইকিপিডিয়া

গানে স্বস্তি খোঁজা

গান ছিল আমার স্বাধীনতার জায়গা। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ঘরে ঢুকে জোরে গান ছেড়ে দিতাম। ক্রিস্টিয়ানা অ্যাগুইলেরা, পিংক আর আলিসিয়া কিসের গান অনবরত বাজতে থাকত। এটাই ছিল আমার স্বস্তি—উপহাস থেকে, একাকিত্ব থেকে, বিষণ্নতা থেকে। আমার বাবার কাছ থেকে এই অভ্যাসটা পেয়েছি। বাবাকেও দেখতাম, প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে এসে গান শুনত।

কৈশোরে সব সময় চুল ছোট করে ছেঁটে রাখতাম, দাঁতে ব্রেস পরতাম। অত টাকা ছিল না আমাদের। তাই জামাকাপড় কিনতাম চ্যারিটি শপ (দাতব্য প্রতিষ্ঠানের দোকান, যেখানে সুলভ মূল্যে পুরোনো বা দান করা পোশাক পাওয়া যায়) থেকে। সেখানে থেকে আমি সেই পোশাকগুলোই নিতাম, যা অন্যরা নিত না। উদ্দেশ্য থাকত সবার চেয়ে আলাদা হওয়া। চুলে অদ্ভুত রং করে রাখতাম, অদ্ভুত ঢঙের পোশাক পরতাম। অনেকেই আমার স্টাইল ভালোভাবে নিত না।

যখন গানের ক্যারিয়ার শুরুর জন্য প্রথম মিটিংয়ে গিয়েছিলাম, তখন এক বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আমার পোশাক দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার চ্যারিটি শপের এই জ্যাকেটটা খুলে রাখো। মিটিংয়ে বসার আগে তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে হবে। কিছু ফ্যাশনেবল পোশাক কিনে দিতে হবে।’

আরও পড়ুন

সেদিনের পর থেকে নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠি। পোশাক, সাজসজ্জা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। ধরেই নিয়েছিলাম, পপতারকা হতে হলে আমাকে একটা নির্দিষ্ট সাজপোশাকে থাকতে হবে সব সময়। সেটা যতই আমার স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে হোক না কেন। ধীরে ধীরে চিন্তাগুলো অনেক বেশি পোশাকি হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে এমনও দিন গেছে, নিজেকে কার্টুনের মতো মনে হয়েছে। কত যে কুৎসিত সাজপোশাক পরেছি, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মোটকথা, সমাজের বেঁধে দেওয়া ফ্রেমে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজের সঙ্গে লড়াই করতাম প্রতিনিয়ত।

নিজেকে ফিরে পাওয়া

কয়েক বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে এক আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন, ‘যত যা-ই করো, নিজের ভেতরের শিশুকে কখনো হারিয়ে যেতে দিয়ো না।’ শুরুতে এর মানে বুঝিনি। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। কৈশোর থেকে বড় হওয়ার যুদ্ধকে আমি অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ফেলেছিলাম। বড় হতে হতে এমনটা সবার সঙ্গেই হয়। তবে আমি সেদিনের পর ঠিক করি, আবার নিজের ভেতরের সেই ছেলেবেলার সত্তাকে খুঁজে বের করব। সেই ছেলেবেলার ‘আমি’-কে ফিরিয়ে আনব। পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে না পারলেও অস্বাস্থ্যকর দিকগুলোকে বাদ দিয়ে আনব। ছোটবেলার মতো দিনভর মিষ্টি জিনিস হয়তো খাব না, কিন্তু আমার কৌতূহল, আমার উচ্ছ্বাস, আমার উদ্যম—সবই হবে ছেলেবেলার মতো। হাওয়াই মিঠাই না খেয়ে, এবার না হয় সবজি, অ্যাভোকাডো, টমেটো, আর কলা খেলাম। কিন্তু পৃথিবীটা আমি আবার সেই ছোটবেলার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছি। তাই এখন আমি নিজের মনের মতো করে সাজি। আমি আর অদ্ভুত কোনো রঙে চুল রাঙাই না। অনেক বছর পর আবার আমি আমার বাদামিরঙা চুল নিয়ে বেশ সুখে আছি। পছন্দমতো গান তৈরি করছি। মানুষ কেমন শুনতে পছন্দ করবে, সেই চিন্তা করছি না। মনে হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে আমি আর হীনম্মন্যতায় ভুগছি না। অনেক অনেক বছর পর আমার আর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। আমি অবশেষে শান্তি খুঁজে পেয়েছি। আর এই শান্তি খুঁজে পেতে আমার লেগেছে মাত্র ১০ বছর!

আরও পড়ুন