নতুন বছরে সফল হতে যেভাবে পরিকল্পনা করবেন
আমার চেনা মানুষের অনেকেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ এলে জোরেশোরে ভাবতে বসেন, নতুন বছরের প্রতিজ্ঞাটা কী হবে। কেউ কেউ নিজেদের সংকল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জানিয়ে দেন। ওজন কমানো, গাড়ি কেনা, বন্ধুদের সঙ্গে আরও ঘনঘন আড্ডা দেওয়া, দুই বছর ধরে ফেলে রাখা উপন্যাস লিখে শেষ করা, দেড় শ বই পড়া, সময়মতো অফিসে যাওয়া, মাঝরাতে আর সাবেক প্রেমিক–প্রেমিকার ফোন না ধরা—কত বিচিত্র ধরনের সংকল্পই না চোখে পড়ে!
নতুন সংকল্পের ব্যাপারটাকে কেউ কেউ হাস্যকর মনে করেন। কেউ কেউ বলেন, এটা ‘দেখনদারি’। আমার কাছে সংকল্প করার এই প্রথা খারাপ লাগে না। প্রচেষ্টা ছাড়া অর্জন হয় না, আর সংকল্প না থাকলে প্রচেষ্টা আসবে কোথা থেকে? সব সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দেওয়া মুশকিল। ২০১৬ সালে আমেরিকায় এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, সেখানে ৪১ শতাংশ মানুষ নতুন বছরে কিছু প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। এই জরিপে মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ বছর শেষে দাবি করেন, তাঁদের সংকল্প পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। কিন্তু তাতে কী? আমগাছে যত মুকুল আসে, তত ফল কি ধরে! কিন্তু যে কটা আম ধরে, তার প্রতিটাই তো কোনো না কোনো মুকুল থেকে এসেছে!
তাই প্রতিজ্ঞা থাকা ভালো। এতে নিজের সামনে একধরনের ইচ্ছা বা আগ্রহ থাকে সেই লক্ষ্য পূরণের।
নতুন বছরের সংকল্প কেমন হওয়া উচিত? ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।’ আমারও মত, নতুন বছরের সংকল্প একটু চিন্তাভাবনা করে নেওয়াই ভালো। সংকল্প করতে হবে এমন, যাতে নিজের সাধ্যের সীমা পর্যন্ত বা তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। কিন্তু সংকল্প যদি সাধ্যের অতিরিক্ত হয়, তা হলে আমাদের অবচেতন মন শুরু থেকেই ধরে নেয়, এই সংকল্প রক্ষা করা যাবে না। অবচেতন মনের সঙ্গে লড়াই করে জেতা খুব কঠিন। আপনি যদি জো বাইডেন হন, আপনার নতুন বছরের সংকল্প হতে পারে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরেকবার দলের কাছ থেকে মনোনয়ন আদায়ের চেষ্টা। লক্ষ্যটা কঠিন, অনেক পরিশ্রম করতে হবে, কিন্তু আপনার সাধ্যের বাইরে নয়।
আবার আপনি যদি অভিনেত্রী জুলিয়ান মুরের মতো কেনাকাটায় আসক্ত হন, আপনার সংকল্প হতে পারে, ‘এ বছর বেহুদা জিনিস কিনে ঘর বোঝাই করব না।’ শুনে সহজ মনে হলেও যাঁদের কেনাকাটায় আসক্তি আছে, তাঁরা জানেন, সারা বছর এই সংকল্প রক্ষা করা কত কঠিন। ২০১৩ সালের শুরুতে আমি সংকল্প করেছিলাম, এক বছরে স্প্যানিশ ভাষা শিখে ফেলব। কিন্তু এক বছরে স্প্যানিশ ভাষা শেখা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে, তাই শেখাও হয়নি। অন্যদিকে ২০১৮ সালের শুরুতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা শরীরের যত্নে ব্যয় করব—হাঁটব, খেলব, ব্যায়াম করব। রোজকার ব্যস্ততার কারণে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা কঠিন হলেও এটি আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল। বছর শেষে দেখলাম, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরেছি।
নতুন বছরের সংকল্প নিজে ঠিক করাই ভালো। অন্যের ঠিক করে দেওয়া সংকল্প রক্ষা করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষই মনের ভেতর থেকে তাগিদ বোধ করেন না। আর সংকল্পের জন্য লক্ষ্য স্থির করাও দরকার। ‘ধূমপান ছেড়ে দেব’ কিংবা ‘শরীরের বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেলব’—এই ধরনের মোটা দাগের সংকল্পের তুলনায় ‘এ বছর দিনে একবারের বেশি ভাত খাব না’ কিংবা ‘তিন কেজি ওজন কমাব’ ধরনের সংকল্প করলে লক্ষ্য অর্জনে নিজেকে অনুপ্রাণিত করা বেশি সহজ।
সংকল্প এমন হোক, যাতে তা রক্ষার বিষয়টি আপনার হাতে থাকে। ‘এ বছর আমি সবার কাছে আরও প্রিয় হয়ে উঠব’ ধরনের সংকল্প রক্ষা করা কঠিন। কারণ, জনপ্রিয়তার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই, ওটা অনেকাংশে নির্ভর করে, যাঁদের কাছে আমরা প্রিয় হয়ে উঠতে চাইছি, তাঁদের ওপর। তার চেয়ে ‘এ বছর আমি রেগে গেলেও কারও সঙ্গে গলার স্বর উঁচু করে কথা বলব না’ ধরনের সংকল্প রক্ষা করা সহজ। কারণ, এটার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আপনার হাতে আছে। আর এই সংকল্প রক্ষা করতে পারলে আপনার জনপ্রিয়তা যে বাড়বে, সেটি বলে দেওয়াই যায়।
অনেকেই নিজের সংকল্পের কথা আত্মীয়-বন্ধুদের বলে বেড়ান। পরিসংখ্যান বলছে, এতে খুব বেশি লাভ হয় না। যে সংকল্পের কথা মানুষ সঙ্গোপনে রাখে, সেসব সংকল্প রক্ষা করার জন্যেই মানুষের তাগিদ বেশি থাকে। তবে অন্য কাউকে না বললেও নিজের সংকল্পটি মনে রাখুন। দরকার হলে যেখানে রোজ চোখে পড়বে, এমন কোনো জায়গায় সংকল্পটি লিখে রাখুন। কারণ, জরিপে এ-ও দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ নিজের নতুন বছরের সংকল্পের কথা তিন-চার মাসের মধ্যেই ভুলে যান।
সংকল্পের পাশাপাশি সেটি রক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা করতে ভুলবেন না। ১৯৫৫ সালের শুরুতে মেরিলিন মনরো সংকল্প করেছিলেন, অভিনেত্রী হিসেবে তিনি আরও সফল হয়ে উঠবেন। এই লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা তিনি ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। লিখেছিলেন, কোন কোন ক্লাস করবেন, কার কার সঙ্গে দেখা করবেন, কী ধরনের বই পড়বেন।
নতুন বছরের সংকল্প সারা বছরের জন্যেই করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। দুই, তিন বা ছয় মাসের জন্যও সংকল্প নিতে পারেন। সংকল্প মেনে চলতে পারলে দরকার হলে বছরের মাঝামাঝি আবার নতুন সংকল্প করবেন। তবে এটা বাস্তবায়নের কাজ ফেলে রাখবেন না। যত দেরি করবেন, সংকল্প বাস্তবায়নের উদ্যম ও সুযোগ তত কমে যাবে, অপ্রত্যাশিত সব বাধা এসে প্রতিজ্ঞা রক্ষাকে দুঃসাধ্য করে তুলবে।
নতুন বছরকে উপলক্ষ করুন বা না–ই করুন, নতুন সংকল্প করুন। আমাদের একটিই জীবন। এই জীবনকে আরও অর্থবহ করতে, উপভোগ্য করতে আমাদের নতুন বছরের মতোই ক্রমাগত নিজেদের নবায়ন করে যেতে হয়। নতুন সংকল্প সেই নবায়নের তাগিদ। আপনার নতুন বছরের সংকল্প শুভ হোক, সংকল্প রক্ষার প্রচেষ্টা সফল হোক।
খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার, গবেষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কিমেকারস কনসাল্টিং লিমিটেড