বৃষ্টির পানি জমিয়ে খেতাম, ব্যবহার করতাম টয়লেটেও

আকস্মিক বন্যায় ৬ আগস্ট সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বান্দরবান। পরের চার দিন একটা রেস্টহাউসে আটকা পড়েছিলেন এ বি এম খায়রুল কবীর। তাঁর কাছ থেকেই শুনুন দুর্বিষহ সেই অভিজ্ঞতার কথা।

অতিবৃষ্টিতে বান্দরবানে দেখা দিয়েছিল আকস্মিক বন্যা
ছবি: লেখক

৬ আগস্ট সকাল থেকেই বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ির কচ্ছপতলীর উদ্দেশে গাড়িতে উঠি। যাওয়ার পথে দেখি জায়গায় জায়গায় পাহাড় ধসে গেছে, রাস্তায় গাছ পড়ে আছে। স্থানীয়দের সহায়তায় গাছ কেটে, মাটি সরিয়ে পরিষ্কার করা হয় রাস্তা। এভাবে সোয়া ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় পাড়ি দিই।

কচ্ছপতলী পৌঁছানোর পর বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ে। এখানে একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় চালায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। তারই কাজে সহকর্মী গোলাম রাব্বানী ও বুদ্ধজ্যোতি চাকমার সঙ্গে এসেছি। বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি। কাজ শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। তখনই চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। ফিরতে উদ্যোগী হলে স্থানীয় লোকজন বারণ করলেন। এ সময় ফেরাটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে জানিয়ে নানা শঙ্কার কথা শোনালেন তাঁরা। কিন্তু সকালেই আমাদের বাস, সেভাবেই টিকিট কাটা। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই তাই ফিরতি পথ ধরি। অনেক জায়গায় তখন রাস্তা তলিয়ে গেছে, বিভিন্ন স্থানে নতুন করে পাহাড়ধসও হয়েছে। দুর্গম হয়ে ওঠা সেই পথেই বান্দরবান ফিরে আসতে আসতে রাত আটটা বেজে যায়। শহরটা দেখি অন্ধকারে ডুবে আছে। সব রাস্তা জলমগ্ন। ভুতুড়ে এক নগরী যেন। জজকোর্ট এলাকায় পাহাড়ের ওপরে আমাদের রেস্টহাউস। পানি ডিঙিয়ে রেস্টহাউসে উঠে আসি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা। হাতে সময় নিয়ে বের হব বলে রাতে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে রাখি। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিই। শুয়ে পড়ার আগে মনে পড়ল, সারা দিন বাসায় কথা হয়নি। কল করতে গিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই!

আরও পড়ুন
বন্যার পানিতে বান্দরবান শহরের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন
ছবি: লেখক

বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই

ভোরেই ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক আসেনি। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। রেস্টহাউসের কোনো কর্মীকেও দেখছি না। কীভাবে বাসস্ট্যান্ডে যাব!

অনেকক্ষণ পর দেখি ছাতা মাথায় একজন আমাদের দিকে আসছেন। তাঁকে থামাই। তিনি জানান, পাশেই যে নির্মাণকাজ চলছে, তার সুপারভাইজার তিনি। রাতে শহরে জলাবদ্ধতা দেখে এসেছি, এখন কী অবস্থা, জানতে চাই তাঁর কাছে। চোখেমুখে শঙ্কা নিয়ে জানালেন, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে শহর তলিয়ে গেছে, রাস্তায় বুকসমান পানি!

১০ ফুট বাই ১০ ফুট কক্ষে আটকে পড়ি আমরা। পাশের কক্ষেই উঠেছেন সহকর্মী গোলাম রাব্বানী। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, মোমবাতি নেই, এমনকি নিত্যব্যবহারের পানিও নেই। ম্যালেরিয়ার ভয়ে দুজন মশারি টানিয়ে অন্ধকারে যাঁর যাঁর রুমে বসে থাকি। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে বালতি বের করে বাইরে রাখি। জমানো সেই পানি দিয়ে দুপুরে গোসল করি, অন্য কাজে ব্যবহার করি।

ততক্ষণে রেস্টহাউসের বাবুর্চি চাচা চলে এসেছেন। জানিয়েছেন বাজার করার সুযোগ নেই। তিনি যা সংগ্রহ করতে পারবেন, তাই খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। কখনো ডিম সেদ্ধ করে, কখনো আলুর ঝোল দিয়ে সেই চেষ্টা তিনি চালিয়ে গেলেন।

রাব্বানীর সঙ্গে ছাতা মাথায় দিনে কয়েকবার করে পাহাড় থেকে নিচে নেমেছি। দেখেছি পানি কমেছে কি না, কারও দেখা পেলে বাস বা অন্য কোনো গাড়ি চলে কি না, খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। চারপাশের ঘরবাড়ি সব পানির নিচে তলিয়ে আছে, আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করছে বানভাসি মানুষ।

আমরা ভালো আছি

সেদিন বিকেলে হঠাৎ বুদ্ধজ্যোতি চাকমার ডাক। রুমের বাইরে বেরিয়ে দেখি বুকসমান পানি ঠেলে আমাদের দেখতে এসেছেন। তিনি জানান, নিউজ রেডি করেও পাঠাতে পারছেন না, নেটওয়ার্ক নেই। শুরু হলো তিনজনের নেট খোঁজার মিশন। একসময় আবিষ্কার করি রেস্টহাউসের ছাদে গেলে মোবাইলে নেটওয়ার্কের আইকন পাওয়া যায়। ঢাকা অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আধা ঘণ্টা চেষ্টার পর একবার সংযোগ পাওয়া যায়। অফিসে জানাই, আমরা ভালো আছি। বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে সেখানকার অবস্থা বর্ণনা করি। অফিস থেকে ছবি পাঠাতে বলে। বেলা সাড়ে তিনটায় কয়েকটি ছবি সেন্ড করি। রাত সাড়ে ১১টায় সেন্ড হয় সেই ছবি!

আরও পড়ুন
তিন দিন পর বন্যার পানি শহর থেকে নামতে শুরু করে
ছবি: লেখক

অসহায় দুটি মুখ

রাতটা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে কেটে যায়। ৮ আগস্ট সকালে উঠেও দেখি অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পাওয়ার ব্যাংকের চার্জে তখনো মোবাইলটি সচল রাখতে পেরেছি। মনে হলো আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা চলবে। গত দুই দিনের ভয় তখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে! পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তারা কী ভাবছে, কে জানে। পাহাড়ের ওপরে গিয়ে দিনে কয়েকবার ঢাকায় কল করার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হই, তবু আবার একই কাজ করি। এর মধ্যে একবার দুটি ছেলে আসে আমার কাছে। সারা শরীর কাদামাখা। ২০ কি ২২ বছর বয়স। ক্লান্ত, মলিন ও অসহায় দুইটা মুখ। দূর থেকে সালাম দিয়ে জানান, পাশের পাহাড়ের ঢালে তাঁদের বাড়ি। ছোট ভাই ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করছে, গত তিন দিন কোনো খবর নিতে পারছে না, দিতেও পারছে না। আমার মোবাইলে কল করে ছোট ভাইকে জানাতে চায় যে পরিবারের সবাই ভালো আছে, কোনো দুশ্চিন্তা যেন না করে। মোবাইলটি বাড়িয়ে দিই, আধা ঘণ্টা চেষ্টা করেও সংযোগ পেতে ব্যর্থ হয়। একটা খুদে বার্তা পাঠানোর অনুরোধ করে। মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই মুঠোফোনের কি-বোর্ড মমতা আর আবেগের শব্দে ভরে ওঠে!

বেদনায় মনটা কেঁদে ওঠে

কিছু শুকনো খাবার নিয়ে রুমে ঢুকেছিলাম। এক বেলা ভাত খেলে অন্য বেলা সেসব খাই। বৃষ্টি একটু কমলে পাহাড় থেকে নিচে নামি। নিচের রাস্তায় একবার এক মায়ের দেখা পাই। সঙ্গে তাঁর কিশোরী কন্যা। চিকিৎসা নিতে তিন দিন আগে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ৪০ কিলোমিটার দূরের রুমা থেকে বান্দরবান এসেছিলেন। শহর ডুবে যাওয়ায় তাঁরাও আটকে পড়েছেন। শহরে কোনো আত্মীয় নেই, তিন দিনে সঙ্গে থাকা টাকাও ফুরিয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে, দুর্গম পানিপথ পাড়ি দিয়ে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হেঁটেই এখন বাড়ি ফিরছেন। বেদনায় মনটা ভিজে যায়, মা-মেয়ের জন্য খুব অসহায় লাগে। রুমে ফিরে ভাবি, আমরা কতটা ভাগ্যবান, এই দুর্যোগে থাকার জায়গাটুকু অন্তত আছে!

৯ আগস্ট বৃষ্টি কমতে থাকে, প্লাবনের পানি শহর থেকে নামতে শুরু করে। তবে সেদিনও কোনো যানবাহন চলাচল করে না।

১০ আগস্ট সকালে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। তখনো কেরানীর হাটসহ কয়েক জায়গায় রাস্তা ডুবে আছে। দু-একটা বাহন বেশ ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে। আমরাও ঝুঁকি নিয়ে চার দিন পর নেটওয়ার্কের ভেতরে ফিরি!