পৃথিবী থেকে নাই হয়ে যেতে পারে এমন দুই পাখি নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশের সায়েম

বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেলে গোটা পৃথিবী থেকেই ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে পাখির দুটি প্রজাতি—চামচঠুঁটো বাটান আর সুন্দরী হাঁস। বছরের পর বছর এই পাখি দুটি নিয়ে কাজ করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত সায়েম ইউ চৌধুরী। এই পাখি–গবেষককে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখেছেন বন্য প্রাণী–গবেষক সীমান্ত দীপু

গবেষণার কাজে সুন্দরবনে সায়েম ইউ চৌধুরী
ছবি: সায়েম চৌধুরীর সৌজন্যে

পূর্ব রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের ছোট্ট বিমানবন্দর এনাডার। ২০১২ সালের মে মাসে এই বিমানবন্দরের একটি রুমে সাত দিন আটকে ছিলেন সায়েম চৌধুরী। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের ৭ ডিগ্রি নিচে ছিল। চারদিকে ঝরছে তুষার। আবহাওয়া ভালো হলেই কেবল হেলিকপ্টার চলবে। তখন যাওয়া যাবে চুকোৎকা। কয়েক দিন আগেই এই গ্রামে পৌঁছে গেছেন ব্রিটিশ পাখি–গবেষকেরা।

তারপর একদিন সায়েমের ছোট্ট রুমটায় এক বৃদ্ধ এসে বললেন, আজ হেলিকপ্টার ছাড়বে। তার কথা শুনে যেন নতুন জীবন পেলেন সায়েম। এর আগে এত ছোট্ট রুমে কখনো এভাবে বন্দী জীবন কাটানো হয়নি। এমন বরফ–আচ্ছাদিত অঞ্চলও আগে দেখেননি সায়েম।

সেদিন হেলিকপ্টারে চুকোৎকায় নেমে সায়েম আরও অবাক। বাইনোকুলারে হাতেগোনা দু-চারটি ঘর শুধু দেখা যায়। এই এলাকায়ই থাকতে হবে দেড় মাস। একটি বড়সড় ক্যাম্প হয়েছে। সেখানেই ছোট্ট একটি তাঁবু টানিয়ে দলের সদস্যদের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হবে। রাতে তাঁবুর বাইরে যাওয়া যাবে না। যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে মেরু ভালুক। এখানে সবাই এসেছে একটি পাখি–গবেষণা কাজে। যে পাখিটির খোঁজে তাঁরা এসেছেন, তার নাম চামচঠুঁটো বাটান (স্পুনবিল স্যান্ডপাইপার)। পাখিটি ডিম পাড়ে এই গ্রামে আর বাচ্চা ফুটলে উড়াল দেয় ভিনদেশে। চলে যায় চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড আর তাঁর দেশ বাংলাদেশে। গোটা পৃথিবীতে এই পাখি আছে মাত্র ২০০ জোড়া। সেগুলোকে বাঁচাতেই সায়েম আর তাঁর দলের এত আয়োজন।

দেশের উপকূলের সৈকত–পাখি নিয়েই এখন সায়েমের কাজ
ছবি: সায়েম চৌধুরীর সৌজন্যে

পাখিশুমারির দিনগুলো

২০০১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পাখিশুমারি দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সায়েম। ১০ দিন ধরে উপকূলজুড়ে চলল শুমারি। প্রতিটি চরে সায়েম তাঁর আধভাঙা টেলিস্কোপ দিয়ে পাখিশুমারি দলকে সাহায্য করলেন। সেই তাঁর পাখি দেখা শুরু। এরপর পেরিয়ে গেছে দুই যুগ। প্রতিবছরই উপকূলে পাখিশুমারি করতে গেছেন। কত পাখির চর যে তাঁর চোখের সামনে হরিয়ে গেছে! এই তো ১০ বছর আগের কথা। একসময় উপকূলের বেশ কয়েকটি চরে তাঁর প্রিয় পাখি চামচঠুঁটো বাটান দেখেছেন সায়েম। ৩০ থেকে ৪০টি পাখির ঝাঁক নিয়মিত এ দেশে আসত। সেই সংখ্যা এখন পাঁচে এসে ঠেকেছে। প্রায়ই তাঁকে বলতে শোনা যায়, ক্ষমতা থাকলে প্রতিটি চর আগলে রাখতেন তিনি। আর সেই চরে ঘুরে বেড়াত সৈকত–পাখিরা। পাখিশুমারি করতে এই জানুয়ারিতেও বাংলাদেশে এসেছিলেন সায়েম। উপকূলে পাখিশুমারি দলের তিনি প্রধান নেতা।

আন্তর্জাতিক পাখি–গবেষক

বরিশাল শহরের ছোট্ট এক মহল্লায় সায়েমের বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর পাখি দেখার নেশা। আর কলেজ পেরিয়ে ২০০৫ সালে ভর্তি হন ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে। এ সময় তাঁর প্রথম গবেষণার কাজ শুরু। বাংলাদেশের সোনাদিয়া দ্বীপে চামচঠুঁটো বাটান নিয়েই গবেষণা শুরু করেন তিনি। এই পাখি গবেষণার কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। চীন, মিয়ানমার, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান থেকে আফ্রিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পাখি গবেষণায় বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন সায়েম। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন দুটি পাখি বাঁচানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গঠিত হয়েছে টাস্কফোর্স। একটি টাস্কফোর্সের নাম স্পুনবিল স্যান্ডপাইপার টাস্কফোর্স আর অন্যটি মাস্কড ফিনফুট টাস্কফোর্স। এই দুটি টাস্কফোর্সেরই নেতৃত্বে আছেন সায়েম। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সায়েম এখন আন্তর্জাতিক পাখিবিজ্ঞানী।

সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁসের জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা করেছেন সায়েম চৌধুরী

পাখির দুটি প্রজাতি সংরক্ষণের দায়িত্ব যাঁর হাতে

বাংলাদেশে থেকে হারিয়ে গেলে গোটা পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যেতে পারে পাখির দুটি প্রজাতি। এর একটি প্রজাতি হলো চামচঠুঁটো বাটান আর অন্যটি সুন্দরী হাঁস (মাস্কড ফিনফুট)। বছরের পর বছর এই দুটি পাখির গবেষণায় মাঠে আছেন সায়েম চৌধুরী। পাখি দুটির বিষয়ে প্রায় সব তথ্যই তাঁর হাতে আছে। কীভাবে পাখি দুটিকে টিকিয়ে রাখা যায়, তার সবই তিনি করছেন। এখনো মনে আছে সুন্দরবনের একটি খালে সায়েম একটানা ২১ দিন বসে ছিলেন। ওই খালে একটি সুন্দরী হাঁস ডিম দিয়েছিল। প্রচণ্ড গরম আর ঝড়ের মধ্যেও ওই খাল থেকে বের হননি তিনি। বের করেছেন পাখিটির সম্পূর্ণ জীবনচক্র; যা এ দেশে প্রথম গবেষণা। এখন সরকারিভাবে এই পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর সায়েমের গবেষণার তথ্য অনেক কাজে আসছে।

সায়েম চৌধুরীর ক্যামেরায় চামচঠুঁটো বাটান

কেমব্রিজের আঙিনা

২০২০ সাল থেকে সায়েম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পিএইচডি করছেন। তাঁর গবেষণার বিষয় এ দেশের উপকূলের সৈকত–পাখি। পড়াশোনার পাশাপাশি সায়েম পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আর সংস্থায় ক্লাস নেন। তাঁর গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৫০। সায়েমের সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. রিস গ্রিম। গোটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংরক্ষণবিদদের একজন তিনি। তাঁর হাত ধরেই সায়েম আরও সমৃদ্ধ হচ্ছেন।

পাখির খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামে সায়েম ইউ চৌধুরী
ছবি: নাজিম উদ্দিন

স্বপ্ন হবে সত্যি

দেশে প্রায় ৭২১ প্রজাতির পাখি আছে। এই তালিকায় বেশ কয়েকটি নতুন প্রজাতির পাখি যোগ করেছেন সায়েম। সায়েমের আশা, এত বড় একটি দেশে সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর আর সোনাদিয়া দ্বীপের মতো কয়েকটি জায়গা পাখির জন্য ছেড়ে দেওয়া হোক।

ভবিষ্যতে পাখি–গবেষণা ছাড়া আর কিছুই করতে চান না সায়েম। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে জলে-জঙ্গলে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছুক, এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে কেন, গোটা পৃথিবীতে বিরল। সায়েমের মতো আমাদের আরও কিছু তরুণ এ দেশের পাখি তথা প্রকৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে এলে দেশটি এগিয়ে যাবে।