আমার সংগ্রহে পাঁচ হাজার বই আছে, কাউকে এসব দিতে পারলে খুশি হব
কৈশোরেই পেয়ে বসেছিল বই সংগ্রহের নেশা। তারপর দিনে দিনে সংগ্রহ করেছেন হাজারো বই। এখনো বইয়ের দুনিয়াতেই বাস। গ্রন্থ সংগ্রাহক হিসেবে ২০১৯ সালে ঢাকা কেন্দ্র থেকে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। সংগ্রাহক মো. শাহজাহান গাজীর গ্রন্থজীবনের গল্প শুনে লিখেছেন মো. জান্নাতুল নাঈম
ক্লাসের শিক্ষক প্রায়ই আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, কে কী বই পড়েছ? যে যা পড়েছে, বলত। বাকিরা সেই গল্প শুনতাম। এটা আমার ভালো লাগত। বরিশাল জিলা স্কুলে আমাদের সচ্ছল বন্ধুরা মাঝেমধ্যে গল্পের বই নিয়ে এলেই সেটা দেখার ইচ্ছা হতো। মনে হতো, যদি এসব বইয়ের মালিক হতে পারতাম। ওই ছোট বয়সে ঠাকুরমার ঝুলি ছিল বেশ পছন্দ। পড়তাম গোয়েন্দা গল্প। তবে বয়সের সঙ্গে রুচি পরিবর্তন হয়। বাঁকা স্রোত দিয়ে আমার প্রথম উপন্যাস পড়ার শুরু। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি বোধ হয়। কিন্তু এই বই পরে অনেক দিন পাইনি। ৭০ বছর বয়সে এসে খুঁজে পেয়েছি এবং সংগ্রহ করেছি। এখন আমার বয়স ৮৫ বছর।
সংগ্রহের শুরু কলেজে
কলেজে ওঠার পর আত্মকথা ও আত্মজীবনীর প্রতি আমার ঝোঁক বাড়ে। নানা বই পড়তে থাকি। জানতে থাকি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। একই সঙ্গে শুরু হয় বই সংগ্রহের বাতিক।
১৯৬৫ সালের দিকে আমি সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যশোরে চাকরি করতাম। দড়াটানায় কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে তখন ভারতীয় ভালো ভালো বই আসত। তখন থেকেই আমি আত্মজীবনী-স্মৃতিকথা ধরনের কিছু কিছু বই কিনতে শুরু করি। সাহিত্যকর্ম পড়ার চেয়ে সাহিত্যস্রষ্টা তথা গুণীজনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমাকে আলোড়িত করে।
সেই আগ্রহ থেকেই আমার সংগ্রহ সমৃদ্ধ হতে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির শাশুড়ির আত্মজীবনী আমার কাছে আছে। ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড যাঁর জন্য ব্রিটিশ সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, সেই মিসেস সিম্পসনের লেখা আত্মজীবনী দ্য হার্ট হ্যাজ ইটস রিজনস আমার সংগ্রহে আছে। ১৯৬৭ সালের দিকে তৎকালীন ডিআইটির পেছনে কিছু বইয়ের দোকান ছিল। সেখানকার বুক সেন্টার নামে একটি দোকান থেকে আমি সেটি দশ টাকায় কিনি। আগা খানের আত্মকথা আছে। উইনস্টন চার্চিলকে সবার মতো আমিও অপছন্দ করতাম। তাঁর বই পড়ে আমার ধারণা বদলেছে। ৬ ভলিউমের বইয়ের সেট আমার লাইব্রেরিতে পাবেন। উইনস্টন চার্চিলের প্রথম বই দ্য স্টোরি অব দ্য মালাকান্দ ফিল্ড ফোর্সও আমার আছে। আদিনাথ সেনের স্বর্গীয় দীননাথ সেনের জীবনী ও তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বইটি ১৯৪৮–এ একবারই ছাপানো হয়েছিল। একটি কপি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে। একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্যে সেটা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থেকে নতুন কপি বাঁধাই করে নিয়েছিলাম।
বই সংগ্রহ নিয়ে একটা গল্প বলি। ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকের কথা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এবং গ্রেট বুকস অব দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড-এর দুটি সেটের বুকলেট পেলাম একজন বিক্রয় প্রতিনিধি মারফত। আগে থেকেই এই বইগুলোর প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু মাসিক যা বেতন পেতাম, তার পুরোটা দিয়েও এক সেট বই কিনতে পেতাম না। তাই অনেকটা মজা করে কিস্তিতে বই কেনার প্রস্তাব দিলাম। তিনি রাজি হলেন। এরপর এত বই নিয়ে বাসায় আসতেই শুরু হলো অশান্তি। দুদিন ঘরের বাইরেও থাকতে হয়েছে!
গুণীজনদের শিকড়ের সন্ধান
শুধু আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা পড়া ও সংগ্রহ করা নয়, কীর্তিমানদের বাড়িঘর, পৈতৃক ভিটা বা বাড়ি, তাঁদের শিকড় কোথায়— সেগুলো সন্ধান করা, ঘুরে দেখা বা খুঁজে বের করাও আমার একটা নেশা।
দুই বাংলার প্রথম বাঙালি নারী আত্মজীবনী লেখক রাসসুন্দরী দেবী। তাঁর আমার জীবন বইয়ে তিনি সরল ভাষায় গ্রাম, সন্তান ও জীবনের গল্প বলেছেন। আমার জানতে ইচ্ছা করত, কোথায় ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বইতে পেলাম, ফরিদপুরের রামদিয়া গ্রাম। কিন্তু বৃহত্তর ফরিদপুরে কোথায় খুঁজব এই গ্রাম। বন্ধুবান্ধব সবাইকে জিজ্ঞেস করতাম। একসময় দেশ উন্নত হলো। সব থানার ম্যাপ তৈরি হলো। আমি ফরিদপুরের সব থানা দেখতে লাগলাম। তিন রামদিয়ার খোঁজ পেলাম। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে। আমি তিনটা রামদিয়াতেই গিয়ে যাচাই করেছি। অবশেষে রাসসুন্দরী দেবীর ভিটা যে রাজবাড়ীর রামদিয়া গ্রাম, সেটা নিশ্চিত হয়েছি।
যাযাবরের (বিনয় মুখোপাধ্যায়) দৃষ্টিপাত আমার পড়া একটা সেরা বই। ১৯৪৬ সালে এটি বের হয়। দুই বাংলাতেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই লেখকের বই এতই ভালো লেগেছে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ১৯৮১ সালে দিল্লিতে গিয়েছিলাম। খোঁজও পেয়েছি। এই সাক্ষাতের আনন্দ তাজমহল দেখার চেয়ে কম ছিল না। তাঁর বাড়ি কিন্তু বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। কিন্তু আমি গ্রামের নাম জেনে আসিনি। ২০০২ সালে আবারও দিল্লি যাই তা জানতে। তত দিনে তিনি মারা গেছেন। তবে কলকাতার বইয়ের সাহায্য নিয়ে আমি তাঁর সেই গ্রামও খুঁজে বের করেছি।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে প্রবাসে আমাদের পাঠ্যবইয়ে ছিল। এত সুন্দর লেখা পড়ে ভাবতাম, ওনার সঙ্গে যদি একবার দেখা হতো। ১৯৯৬–৯৭ সালের দিকে অন্নদাশঙ্করের ঠিকানা পাই। কলকাতায় গিয়ে দেখা করে পায়ের ধুলো নিয়েছি। ৯৩ বছর বয়সেও তিনি আমাকে সময় দিয়েছেন, আমার নাম তাঁর খাতায় লিখে রেখেছেন।
প্রথম ভারতীয় বাঙালি বৈমানিক ইন্দ্রলাল রায় ১৯১৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে মারা যান। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তাঁর কবর দেখতে যাব। আমার ছেলে ফ্রান্সেই চাকরি করত। বলামাত্র সে ব্যবস্থা করেছিল। ২০১৮ সালে প্যারিস থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে গিয়ে দীর্ঘদিনের ইচ্ছাটা পূরণ করেছি।
এ রকম অনেক গুণীজনের শিকড়ের সন্ধান করেছি।
সবাই বই পড়ুক
আমার স্ত্রী–সন্তান আমার বই সংগ্রহের বাতিককে অপছন্দ করে না, তবে হয়তো একটু পাগলামি ভাবে। এখন পাঁচ হাজার বই সংগ্রহে আছে। কয়েক বছর আগেও কেউ যদি আমার কোনো বই চাইত, দিতে রাজি হতাম না। কিন্তু এখন আমার সেই মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বই মানুষকে দিয়েও দিয়েছি। বইকে সত্যি ভালোবাসে, এমন কাউকে এসব বই দিতে পারলে খুশি হব। আমি মনে করি, বই সবাই পড়ুক, সবার কাছেই থাকুক।