বাবারে, মাটিই আমাদের সব
মায়ের কাছে টেপাপুতুল বানানো শিখেছিলেন শোভা রানী পাল। ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সেও কাজটি করে যাচ্ছেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের এই মৃৎশিল্পী। তাঁর আরও গল্প শুনে লিখলেন সজীব মিয়া
আমার বাবার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। পাল বংশের মানুষ আমরা। বাপ-চাচাদের মাটির জিনিসপত্র বানানো দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। বাবা মাটির হাঁড়ি–পাতিল বানাতেন। তাঁকে সাহায্য করার পাশাপাশি মা বানাতেন টেপাপুতুল। মায়ের কাছেই এই কাজ শিখি। এরপর হাতি, ঘোড়া বানানো শিখেছি নিজে নিজেই। বৈশাখী মেলা, রাসমেলা, চড়ক মেলায় বাবা হাঁড়ি বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন। আমিও বাবার সঙ্গে যেতাম পুতুল, হাতি, ঘোড়া নিয়ে।
এরপর বড় হলাম। ছোটবেলার মতো মেলায় যাওয়া বন্ধ হলো। তখন পুতুল বানিয়ে বানিয়ে বাবাকে দিতাম, বাবাই বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন।
১৬ বছর বয়সে বউ হয়ে এলাম দেলদুয়ারের গোমজানী গ্রামে। দেশ স্বাধীন হলো অগ্রহায়ণ মাসে, আমার বিয়ে হলো মাঘ মাসে। স্বামী গৌর পালও মাটির জিনিসপত্র বানান। তিনি এর পাশাপাশি প্রতিমাও বানাতে পারতেন। পূজার সময় তাঁর কাজের চাপ বেড়ে যায়। আমি তখন বাড়িতে কাজের ফাঁকে পুতুল-পশুপাখি বানাই। এই কাজ করতে আমার আনন্দ লাগে। ব্যাঙ, হাতি, গরু, বাঘ—যা দেখি, তা–ই বানাতে পারি।
বিয়ের বছর দশেক পর আমার স্বামী মারা গেলেন। তত দিনে সংসারে চার ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে কী যে কষ্টের দিন শুরু হলো। সংসারে কত কিছু দরকার হয়, কিন্তু টাকা কই পাই। তখন ডালিতে পুতুল তুলে দিয়ে বড় ছেলেকে বলতাম, ‘যাও বাবা, বেচে কিছু কিনে নিয়ে আসো।’
ছেলে আমার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেগুলো বিক্রি করে তেল, লবণ কিনে আনত। তাদের বলতাম, বাবারে, মাটিই আমাদের সব। তারাও ছোট থাকতেই কাজ শিখে ফেলে আয়রোজগারের রাস্তা করে নেয়।
এখন সবাই বড় হয়ে গেছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলের সঙ্গে থাকি। ছেলের বউরাও আমাকে কোনো কাজ করতে দিতে চায় না। কিন্তু কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়?
ছোট ছেলে গোবিন্দ পাল পাট (টয়লেটের কুয়োয় বসানোর জন্য) বানায়। মাটি ছেনে দিই আমরা সবাই। দিনে এসব কাজের ফাঁকেই পুতুল, পাখি, হাতি, ঘোড়া বানাতে বসি। ছেলে সময় পেলে আমার বানানো পুতুল ‘ফিনিশিং’ দেয়। এক দিনে ১০টার মতো বানাতে পারি। আসলে শুধু পুতুল বানিয়ে তো আর সংসার চলে না। এসব শখের কাজ, অন্য কাজের ফাঁকে করতে হয়।
চারুকলায় আমাদের মূল্যায়ন হয়
আমাদের গোমজানী পালপাড়ায় ৪০ পরিবার। তার মধ্যে ৩০ পরিবার এখনো মাটির কাজ করে। ধীরে ধীরে অনেকে পূর্বপুরুষের কাজটা ছেড়ে দিচ্ছে। আমার ঘরেই তো বড় ছেলের নাতি এই পেশায় আসেনি। বড় জামাইও অন্য পেশায় চলে গেছে। আসলে কাজটা ভালো, টাকাপয়সাও আছে, কিন্তু তেমন মূল্যায়ন নেই।
তবে চারুকলার এই মেলায় এলে আমাদের মূল্যায়ন হয়। তাই আসতেও ভালো লাগে। এখানে এলে ছেলেমেয়েরা খুব আদর করে। গত ৮-১০ বছর হলো প্রতিবছর আমি আসি। কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। একসঙ্গে থাকি, খাই।
এবার বরিশালের মেলার জন্য পুতুল বানানো হয়েছিল। কিন্তু মেলাটা আর হয়নি। তখন মনে হয়েছিল চারুকলার মেলাও মনে হয় হবে না। তাই প্রস্তুতি তেমন ছিল না। কিন্তু যখন জানানো হলো, তখন হাতে তেমন সময়ও ছিল না।
তাড়াতাড়ি করে যা বানানো যায়, তা-ই বানিয়ে এনেছি। এর মধ্যে পুতুল ছিল পনেরো শ। সব বিক্রি হয়ে গেছে। টেপাপুতুলগুলো ১০ টাকা করে বিক্রি করেছি। বড় পুতুল ১৫০-২০০ টাকায়। পাখিগুলোও ভালোই বিক্রি হয়েছে।
এখন তো বয়স হয়েছে। বাঁ চোখে কম দেখি। এবার আসার আগে তা-ই ছেলে বারবার বলছিল, ‘মা, গাঁট্টিগুট্টি নিয়ে যাইতে হবে, এবার তুমি যাইয়ো না।’
ছেলেকে জোরাজুরি করে বলছি, ‘বাবারে, এক চোখে তো দেখতে পাই। সমস্যা হবে না, আমারে নিয়ে যাও।’
আজকে (২৯ ডিসেম্বর) মেলা শেষ হবে। অনেকে রাতেই বাড়ি ফিরব। এখন মনে হচ্ছে, আগামী বছর আসতে পারব তো?